সূচিপত্র
ক্রম বিষয়
1. ভূমিকা
2. জুমু‘আর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য
3. জুমু‘আর দিনের বিধি-বিধান
4. জুমু‘আর দিনের ওয়াজিব বা ফরযসমূহ
5. জুমু‘আর দিনের মুস্তাহাব আমলসমূহ
6. জুমু‘আর দিনের নিষিদ্ধ কার্যাদি
7. জুমু‘আর সালাত সম্পর্কে বিভিন্ন আহকাম
ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম
সকল প্রশংসা আল্লাহর, সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর সঠিক অনুসারীদের ওপর।
আল্লাহ কোনো কোনো স্থানকে অপর স্থানের চেয়ে বেশি মর্যাদা
দান করেছেন এবং কোনো কোনো সময়কে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। মাসসমূহের মধ্যে রমযান
মাসকে এবং দিনসমূহের মধ্যে আরাফার দিন, দুই ঈদের দিন ও জুমু‘আর দিনকে মর্যাদা দান করেছেন।
তাই ইসলামে জুমু‘আর দিনের রয়েছে উচ্চ মর্যাদা।
জুমু‘আর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন সহীহ হাদীসসমূহে জুমু‘আর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে
কিছু উল্লেখ করা হলো:
১. জুমু‘আর দিন দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে জুমু‘আর দিন সেরা
দিন ও আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দিন। আল্লাহর নিকট তা ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিনের
চেয়েও উত্তম।”[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘যে সকল দিনে সূর্য উদিত হয়েছে তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো
জুমু‘আর দিন। সেই দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে
এবং সেই দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং সেই দিনেই জান্নাত থেকে তাকে বের
করা হয়েছে।”[2]
২. জুমু‘আর দিন মুসলিমদের ঈদের দিন:
যদি ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আযহা জুমু‘আর দিনে হয় তাহলে সেই দিনে দুই ঈদ একত্রে হবে। যে ব্যক্তি
সেই দিন ঈদের সালাত আদায় করবে তার ওপর জুমু‘আর সালাত ফরয না।
সে ইচ্ছা করলে জুমু‘আর সালাতে আসতেও পারে, নাও আসতে পারে (যোহর আদায় করবে)। ইবন আব্বাস
রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি যখন এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন:
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي
وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائدة: ٣]
‘‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম
ও তোমাদের ওপর আমার নি‘আমতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসাবে প্রদান
করে সন্তুষ্ট হলাম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩] তখন তার নিকট
একজন ইয়াহূদী ছিল। সে বলল: যদি আয়াতটি আমাদের ওপর নাযিল হত তাহলে আমরা সেই দিনটিকে
ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। অতঃপর ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন: আয়াতটি ঈদের দিনেই
নাযিল হয়েছে (আর তা ছিল) জুমু‘আর দিন ও ‘আরাফার দিন।”[3]
৩. জুমু‘আর দিন মন্দ কাজ দূর করা ও গুনাহ মাফের দিন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এক জুমআ থেকে অপর জুমু‘আ এতদুভয়ের
মাঝের (গুনাহের জন্য) কাফ্ফারা হয়ে যায়, যদি কবীরা গুনাহের
সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে থাকে।”[4]
৪. জুমু‘আর সালাতে যাত্রাকারীর প্রত্যেক ধাপে এক বছরের সালাত ও সাওম পালনের ছওয়াব হয়:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন ভালো
করে গোসল করে সকাল সকাল মসজিদে আসবে এবং ইমামের নিকটবর্তী হবে এবং মনোযোগ দিয়ে (খুৎবা)
শ্রবণ করবে ও চুপ থাকবে তার জুমু‘আর সালাতে আসার প্রত্যেক
পদক্ষেপে এক বছরের সালাত ও সাওম পালনের ছওয়াব হবে।”[5]
৫. জুমু‘আর দিনে একটি সময় আছে যে সময়ে দো‘আ কবুল হয়:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় জুমু‘আর দিনে এমন একটি সময়
আছে যে সময়ে কোনো মুসলিম আল্লাহর নিকট কোনো ভালো জিনিসের প্রার্থনা করলে তিনি তাকে
তা দান করেন। তিনি বলেন: আর তা সামান্য সময় মাত্র।”[6]
অধিকাংশ আলেমের মতে, দো‘আ কবুলের সম্ভাবনার সেই সময়টি হলো আসরের সালাতের পরের সময়। দ্বিপ্রহরের
পরের সময়টিতেও দো‘আ কবুলের আশা করা যেতে পারে। সুতরাং মুসলিমগণের
উচিৎ এ সময়টিতে নিজের ও সকল মুসলিমদের জন্য
বেশি বেশি দো‘আ করা।
৬. অন্যান্য উম্মতকে এ থেকে বিভ্রান্ত করে জুমু‘আর দিনকে আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য বাছাই করে রেখেছিলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমু‘আ থেকে আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী
উম্মতকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিলেন। ফলে ইয়াহূদীদের জন্য ছিল রবিবার। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে
নিয়ে এসেছেন এবং আমাদেরকে জুমু‘আর দিনের জন্য পথ দেখিয়েছেন
অতঃপর শনি তারপর রবি। এমনিভাবে কিয়ামতের দিনও তারা আমাদের পরে হবে। দুনিয়ার অধিবাসীদের
মধ্যে আমরা সবার পরে এবং কিয়ামতের দিন আমাদের ফয়সালা সাবার আগে হবে।”[7]
৭. জুমু‘আর দিনেই কিয়ামত হবে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘কিয়ামত জুমু‘আর দিনেই কায়েম হবে।”[8]
৮. জুমু‘আর দিনে মৃত্যুবরণ করা শুভ মৃত্যুর লক্ষণ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কোনো মুসলিম যদি জুমু‘আর দিনে
অথবা জুমু‘আর রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা
তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন।”[9]
৯. জুমু‘আর সালাত ত্যাগ করা কবীরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আ ত্যাগের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘যে সকল লোক জুমু‘আ ত্যাগ করে তারা যেন অবশ্যই তা
থেকে ফিরে আসে, নচেৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদের হৃদয়ের ওপর মোহর
মেরে দিবেন অতঃপর তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”[10]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অবহেলা করে তিন জুমু‘আ ত্যাগ করবে আল্লাহ তার হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিবেন।”[11]
অপর একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার ইচ্ছা হয়,
কোনো ব্যক্তিকে লোকদের ইমামতি করার আদেশ দেই, অতঃপর যে সকল লোক জুমু‘আর সালাতে আসে নি তাদের ঘর-বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে সেগুলোকে জ্বালিয়ে দেই।”[12]
উপরোক্ত হাদীসসমূহ জুমু‘আর সালাতের গুরুত্বের ওপর তাকিদ দিচ্ছে। এর অর্থ এই নয় যে, শুধুমাত্র জুমু‘আর সালাতই ফরয; বরং জুমু‘আর সালাত যেমন ফরয তেমনিভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামা‘আতে আদায় করাও ওয়াজিব।
জুমু‘আর দিনের বিধি-বিধান
জুমু‘আর দিনের ওযাজিব বা ফরযসমূহ:
১. খুৎবার সময় চুপ থাকা, কথা না বলা ও কোনো অযথা কাজ না করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যদি জুমু‘আর দিন ইমামের খুৎবারত
অবস্থায় তোমার সাথীকে (কাউকে) বল: চুপ কর, তাহলে তুমি নিরর্থক
কথা বললে।”[13]
২. মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা, যদিও তা ইমামের খুৎবারত অবস্থায় হয়:
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, জুমু‘আর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবারত
অবস্থায় এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। তিনি তাকে বললেন, ‘‘তুমি সালাত
আদায় করেছ?” সে বলল: না, তিনি বললেন,
‘‘দাড়াও! দুই রাকাত সালাত আদায় কর।”[14]
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে: জুমু‘আর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবারত
অবস্থায় সুলাইক আল-গাতফানী রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে এসে বসে গেল। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘হে সুলাইক!
দাড়াও, দুই রাকাত হালকা সালাত পড়।” অতঃপর তিনি বললেন,
‘‘জুমু‘আর দিন ইমামের খুৎবারত অবস্থায় তোমাদের
কেউ আসলে হালকা করে দুই রাকাত সালাত পড়।”[15]
৩. জুমু‘আর সালাত আদায় করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জামা‘আতের সাথে জুমু‘আর সালাত
আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরয, তবে চারজন এর
বতিক্রম, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বালক এবং অসুস্থ ব্যক্তি।”[16]
জুমু‘আর দিনের মুস্তাহাব আমলসমূহ:
১. জুমু‘আর দিনে ফজরের সালাতে বিশেষ কিরা‘আত পাঠ করা:
জুমু‘আর দিনে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে প্রথম রাকাতে সূরা আস-সাজদাহ ও দ্বিতীয়
রাকাতে সূরা আদ-দাহার (ইনসান) পড়তেন।”[17]
২. বেশি বেশী দরূদ শরীফ পাঠ করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে জুমু‘আর দিন তোমাদের
সর্বোত্তম দিনসমূহের মধ্যে অন্যতম। সেই দিনে আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে
এবং তার জান কবজ করা হয়েছে, শিঙ্গায় ফুৎকার হবে এবং (আসমান
ও যমীনবাসী) ধ্বংস অথবা বেহুশ হবে। সুতরাং সে দিনে বেশি বেশি করে আমার ওপর সালাত
পাঠ কর; কেননা তোমাদের সালাত আমার নিকট পেশ করা হয়।” তারা
(সাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর
রাসূল! আমাদের সালাম আপনার নিকটে কিভাবে পেশ করা হবে অথচ তখন আপনি (অর্থাৎ তাঁর হাড্ডি)
পুরাতন হয়ে যাবেন? তিনি বললেন, আল্লাহ
নবীগণের শরীর মাটির জন্য খাওয়া হারাম করে দিয়েছেন।”[18]
৩. সূরা কাহাফ পাঠ করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন সূরা
কাহাফ পাঠ করবে অপর জুমু‘আ পর্যন্ত একটি নূর তাকে আলোকিত করবে।”[19]
৪. গোসল করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন. ‘‘তোমাদের কেউ জুমু‘আর সালাতে আসতে
চাইলে সে যেন অবশ্যই গোসল করে আসে।”[20]
এ হাদীসে উল্লেখিত আদেশ থেকে গোসল ফরয সাব্যস্ত হবে না; বরং তার অর্থ হলো গোসল উত্তম; কেননা
অপর একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কেউ যদি ওযূ করে জুমু‘আর সালাতে আসে তা যথেষ্ট
হবে। তবে গোসল করা উত্তম।”[21]
৫. মেসওয়াক করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা:
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমু‘আর দিন প্রত্যেক বালেগ (বয়সপ্রাপ্ত) ব্যক্তি
গোসল ও মেসওয়াক করবে এবং সামর্থ্য অনুসারে সুগন্ধি লাগাবে।”[22]
৬. সামর্থ্য অনুসারে সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরিধান করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন গোসল
ও সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে এবং সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরিধান করে, অতঃপর শান্তভাবে মসজিদে আসে, মনে চাইলে সালাত পড়ে,
কাউকে কষ্ট না দেয়, ইমাম আসার পর থেকে নিয়ে
সালাত আদায় পর্যন্ত চুপ থাকে তার জন্য এটা উভয় জুমু‘আর মাঝের
কাফ্ফারা হবে।”[23]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘তোমাদের কারো যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে সে কাজের দুটি পোশাক
ব্যতীত জুমু‘আর জন্য দুটো আলাদা পোশাক রাখতে পারে,
তাতে কোনো অসুবিধা নেই।[24]
৭. সকাল সকাল সালাতের জন্য যাওয়া:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিনে (সহবাসের
পর) ফরয গোসল করে অতঃপর (জুমু‘আর উদ্দেশ্যে) গমন করে সে যেন
একটি উট ছদকা করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ভাগে গমন করে সে যেন একটি গরু ছদকা করল। যে ব্যক্তি
তৃতীয় ভাগে গমন করে সে যেন একটি মেষ ছদকা করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ ভাগে গমন করে সে যেন
একটি মুরগী ছদকা করল। যে ব্যক্তি পঞ্চম ভাগে গমন করে সে যেন একটি ডিম ছদকা করল। যখন
ইমাম (খুতবার উদ্দেশ্যে) বের হয়ে আসে তখন ফেরেশতাগণ হাজির হয়ে যিকির (খুৎবা) শ্রবণ
করতে থাকে।[25]
৮. ইমাম সাহেব খুৎবার জন্য বের হওয়ার আগ পর্যন্ত (নফল) সালাত ও যিকিরে লিপ্ত থাকা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি গোসল
করে জুমু‘আর সালাতে আসবে অতঃপর ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত
তাওফীক অনুসারে সালাত পড়বে ও চুপ থাকবে তারপর ইমামের সঙ্গে জুমু‘আর সালাত আদায় করবে তাকে (তার গুনাহ) সামনের জুমু‘আ এবং তার পরের তিন দিন পর্যন্ত ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”[26]
৯. দ্বিপ্রহরের সঙ্গে সঙ্গে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি জুমু‘আর সালাত কায়েম করা:
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলার পর জুমু‘আর সালাত আদায়
করতেন। তিনি আরো বলেন: আমরা জুমু‘আর সালাত আগেভাগে পড়ে নিতাম
এবং জুমু‘আর পর (দুপুরের খানা খেয়ে) আরাম করতাম।[27]
সালামা ইবন আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমরা রাসূলূল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সূর্য ঢলার পর জুমু‘আর সালাত আদায় করতাম এবং সালাতের পর (সূর্যের অত্যাধিক তাপের
কারণে) ছায়ায় ফিরে আসতাম।[28]
১০. জুমু‘আর সালাতের দুই রাক‘আতে সূরা আল-আ‘লা ও সূরা আল-গাশিয়া পাঠ করা অথবা সূরা আল-জুমু‘আ ও সূরা আল-মুনাফিকূন পাঠ করা:
নু‘মান ইবন বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের এবং জুমু‘আর সালাতে সূরা আল-আ‘লা ও সূরা আল-গাশিয়াহ পড়তেন।[29]
ইবন ‘আব্বাস
রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম জুমু‘আর সালাতে সূরা আল-জুমু‘আ ও সূরা আল-মুনাফিকূন পাঠ করতেন।[30]
১১. জুমু‘আর পরে বাড়ীতে দুই রাকাত অথবা মসজিদে চার রাকাত সালাত আদায় করা:
আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম জুমু‘আর পরে (বাড়ীতে) না ফিরা পর্যন্ত কোনো সালাত
পড়তেন না। (বাড়ী ফিরার) পরে দুই রাকাত সালাত আদায় করতেন।[31]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমরা যখন জুমু‘আর সালাত আদায় করবে তখন জুমু‘আর পর চার রাকাত সালাত পড়বে।[32]
জুমু‘আর দিনের নিষিদ্ধ কার্যাদি:
১. দ্বিতীয় আযানের পরে বেচা-কেনা:
আল্লাহ তা‘আলা-এর বাণী:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَوٰةِ مِن يَوۡمِ
ٱلۡجُمُعَةِ فَٱسۡعَوۡاْ إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَذَرُواْ ٱلۡبَيۡعَۚ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ
لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٩﴾ [الجمعة: ٩]
‘‘হে ঈমানদারগণ! জুমু‘আর দিনে যখন
সালাতের আযান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও
এবং ক্রয়-বিক্রয় ছেড়ে দাও। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা তা জানো।” [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ৯]
২. মানুষের কাঁধের পর দিয়ে অতিক্রম করা এবং দুই জনকে বিচ্ছিন্ন করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খুৎবারত অবস্থায়
এক ব্যক্তি এসে লোকদের কাঁধের ওপর দিয়ে অতিক্রম করছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন,
‘‘তুমি আসতে দেরীও করলে এবং (মানুষকে) কষ্টও দিলে।”[33]
৩. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে বসা।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে বসতে নিষেধ করেছেন।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার ছাত্র নাফে‘ কে জিজ্ঞাসা করা হলো- এটা কি জুমু‘আর সালাতের ব্যাপারে? তিনি উত্তরে
বললেন: জুমু‘আ হোক বা অন্য কিছু হোক।[34]
৪. জুমু‘আর সালাতের পূর্বে মসজিদে দলবদ্ধ হয়ে বসা।
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আর সালাতের পূর্বে মসজিদে দলবদ্ধ হয়ে বসতে নিষেধ করেছেন।”[35]
৫. খুৎবা অবস্থায় বৃষ্টির জন্য দো‘আ ব্যতীত অন্য কোনো দো‘আতে হাত না উঠানো (ইমাম হোক বা মুক্তাদি হোক)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত আছে যে:
তিনি যখন জুমু‘আর খুৎবাতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা
করেন, তখন তিনি তাঁর দুহাত উঠান এবং সাহাবায়ে কেরামগণও তাঁদের
দু’হাত উঠান।[36]
৬. জুমু‘আর দিনকে বিশেষ কোনো সালাত ও সাওমের জন্য নির্দিষ্ট করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘অন্যান্য দিনসমূহের মধ্যে জুমু‘আর দিনকে বিশেষ কোনো সাওমের জন্য এবং জুমু‘আর রাতকে
বিশেষ কোনো সালাতের জন্য নির্দিষ্ট করো না। তবে যদি তোমাদের কারো কোনো (নফল) সাওমের
দিন সেই দিনেই পড়ে যায় (তাহলে তাতে কোনো আপত্তি নেই)।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘‘তোমাদের কেউ জুমু‘আর দিনে রোযা
রেখো না। তবে তার আগের একদিন অথবা পরের একদিন সহ রাখতে পার।”[37]
জুমু‘আর সালাত সম্পর্কে বিভিন্ন আহকাম
১. যে ব্যক্তি জুমু‘আর সালাতের এক রাকাত পেল সে জুমু‘আর সালাত পেল।
সুতরাং যদি কেউ এক রাকাত পায় তাহলে সে তার সাথে অপর রাকাত মিলাবে, আর যদি এক রাকাতের চেয়ে কম পায় তাহলে সে যোহর আদায় করবে।
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: যদি তুমি জুমু‘আর সালাতের এক রাক‘আত পাও,
তাহলে তার সাথে অপর এক রাকাত মিলিয়ে পড়। আর যদি তুমি রুকুও না পাও,
তাহলে চার রাকাত (যোহর) আদায় করে নাও।[38]
২. (মসজিদে) ঝিমুনি আসলে জায়গা পরিবর্তন করে বসা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমু‘আর দিন (মসজিদে) তোমাদের
কারো ঝিমানি আসলে সে যেন তার জায়গা পরিবর্তন করে বসে।”[39]
৩. কোনো শর‘ঈ ওযর যেমন অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো কারণে কেউ
জুমু‘আতে হাযির হতে না পারলে যোহরের সালাত আদায়
করবে। এভাবে মহিলাগণ, মুসাফির ও লোকালয়ের বাইরের অধিবাসীগণ
যোহর আদায় করবেন।
এর দলীল হাদীসে রয়েছে এবং এটাই হলো অধিকাংশ আলেমের মত।[40]
৪. যে ব্যক্তি সফরে থাকবে তার ওপর জুমু‘আর সালাত ফরয নয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে জুমু‘আর সালাত পড়তেন না। তাঁর বিদায় হজের ‘আরাফার দিন জুমু‘আর দিন ছিল, কিন্তু তিনি সেখানে
জুমু‘আর সালাত পড়েন নি; বরং যোহর
ও আছরের সালাত যোহরের সময়ে একত্রে আদায় করেছেন। এভাবে তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীনও করেছেন।
৫. জুমু‘আর সালাত শহরে ও গ্রামে উভয় স্থানেই কায়েম হতে পারে।
ইবন ‘আব্বাস
রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদের পরে
যেখানে সর্বপ্রথম জুমু‘আর সালাত কায়েম হয়েছে তা হলো আব্দুল
কায়েস গোত্রের মসজিদে। আর সে ছিল বাহরাইনের ‘জুওয়াছা’ নামক স্থানে।[41]
‘জুওয়াছা’ হলো আব্দুল কায়েস গোত্রের একটি অন্যতম গ্রাম।[42]
সমাপ্ত
_________________________________________________________________________________
লেখক: শাইখ আবদুল আযীয ইবন আহমাদ আল-উমাইর
বিদেশীদের জ্ঞানদানকারী অফিস, আল-আহসা
অনুবাদক: উমর ফারূক আবদুল্লাহ
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
উৎস: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
0 মন্তব্যসমূহ