ইতোপূর্বে
আমি বিভিন্ন লেখায় পর্দার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি।
আলহামদুলিল্লাহ পর্দাকে অত্যাবশ্যক জ্ঞানে আমাদের কন্যা-জায়া-জননীরা পর্দা
করেনও বটে। এখন ভাবনার বিষয় হলো, অধিকাংশ মা-বোন যে পর্দা
রক্ষা করেন কিংবা যে পোশাকে নিজেকে পর্দাশীল ভাবেন তা কি শরীয়তের কাম্য
পদ্ধতিতেই হয়? তারা যে পর্দা করেন তার কতটা শরীয়তের রূপরেখা মেনে করা
হয়? বক্ষমাণ নিবন্ধে আমরা সে বিষয়টিই আলোচনার বিনীত প্রয়াস পাব
ইনশাআল্লাহ।
প্রিয়
মুসলিম বোন, এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা আপনার জন্য সে বিষয়টিই তুলে ধরতে
চেয়েছি যা আপনাকে কল্যাণের পথ দেখাবে। যা হবে আপনার জীবন চলার পথে এক অতি
দরকারি আলোকবর্তিকা। সে বোনদের জন্য যারা কি-না শরঈ পর্দা রক্ষায় দৃঢ়
প্রতিজ্ঞ। যারা আল্লাহর হুকুম বা বিধানকে আল্লাহরই নির্দেশিত উপায়ে পালনে
দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সবার আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, যারা গতানুগতিক পর্দা
করেন, যা মূলত রব কর্তৃক নির্ধারিত একটি ফরযের অপভ্রংশ বা বিকৃতির
নামান্তর তাদেরও বিনীতভাবে বলব, কুরআন ও সুন্নাহর আলোক বিধৌত আলোচনা পড়ে
আপনিও খানিক নিজেকে মূল্যায়ন করুন। নিজের পর্দা ও পোশাক নিয়ে একটু
পর্যালোচনা কিংবা আত্মসমালোচনা করুন। আখেরে তা আপনারই মঙ্গল বয়ে আনবে।
যেমন ইহকালে তেমনি পরকালে।
হে
ইসলামের কন্যারা, যেনতেনভাবে আসলে পর্দা হয় না। বিস্ময়কর শোনালেও সত্য,
হিজাব পরেও আপনি বেপর্দা নারীদের মধ্যে শামিল হতে পারেন :
• একেবারে সরু তথা আঁটশাট পোশাক পরে।
• প্যান্টের সঙ্গে বুটিকের কাজ করা আকর্ষণীয় স্কার্ফ মাথায় জড়িয়ে।
• ডিজাইন করা লেহেঙ্গার সঙ্গে পাতলা ফিনফিনে স্কার্ফ মাথায় জড়িয়ে।
• আপনার উন্মুক্ত বাহুদ্বয় এবং অনাবৃত পদযুগলের কারণে।
• আপনার অলংকার শোভিত নিমন্ত্রণমূলক পদবিক্ষেপের পরিণামে।
• মোহনীয় দৃষ্টি, সুরেলা কণ্ঠ এবং কাঁচভাঙ্গা হাসি দিয়ে।
• আপনার সুরভিত ঘ্রাণ, সুউচ্চ হিল এবং অনুরণিত শব্দ দিয়ে।
• চেহারায় সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর বর্ণের সুদীপ্ত আভা ছড়িয়ে।
কারণ,
হিজাব কোনো প্রতীক নয়। ফ্যাশনের উপকরণ কিংবা সৌন্দর্য বর্ধনের সামগ্রীও
নয়। এ এক অবশ্য পালনীয় বিধান। আল্লাহ এ হিজাব ফরয করেছেন মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর
ওপর। এর প্রবর্তক আমরা কেউ নই; খোদ পুরুষ-নারীর স্রষ্টা মাবুদ আল্লাহ। অতএব
এ বিষয়ে আমরা ভিন্ন মত দিতে পারি না। পারি না নতুন কিছু আবিষ্কার করতে।
পারি না এর কোনো বিকল্প উদ্ভাবন করতে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿
وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ
وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ
وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦ ﴾
[الاحزاب: ٣٦]
‘আর
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য
নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’। {সূরা আল-আহযাব, আয়াত :
৩৬}
সত্যি
বলতে হিজাব বা পর্দা ফরয হওয়া সম্পর্কে এত বেশি আয়াত ও হাদীস উল্লেখিত
হয়েছে এবং এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও রূপরেখা সম্পর্কে এত বাণী ও বক্তব্য
বিদ্যমান যে এ নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবা ও প্রচারের যৌক্তিকতা নেই।
পূর্ণ ইসলামী পর্দার বিবরণ
আল্লাহ
তা‘আলা মুসলিম নারীর সম্মানার্থে এবং দুষ্ট লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে তার
মর্যাদা রক্ষার্থে পর্দা ফরয করেছেন। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে নারীর
ফিতনা থেকে তেমনি নারীকেও রক্ষা করে এ থেকে সৃষ্ট নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার
থেকে। ইসলামে প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য বেগানা পুরুষের সামনে পূর্ণ পর্দা
রক্ষা করা জরুরী। তারা হলেন মাহরাম ব্যতীত বাকি সবাই। আর মাহরামগণ হলেন :
১. পিতা। ২. দাদা। ৩. স্বামীর পিতা তথা শ্বশুর। ৪. স্বামীর সন্তান তথা
বৈমাত্রেয় পুত্র। ৫. নিজের পুত্র। ৬. ভাই। ৮. ভাইপো। ৯. বোনপো। ১০
চাচা-জ্যাঠা। ১১. মামা। দুধ পানজনিত মাহরামগণ যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত
হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿
وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ
فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ
وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبۡدِينَ
زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوۡ ءَابَآئِهِنَّ أَوۡ ءَابَآءِ
بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآئِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ
إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ أَخَوَٰتِهِنَّ
أَوۡ نِسَآئِهِنَّ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ
غَيۡرِ أُوْلِي ٱلۡإِرۡبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفۡلِ ٱلَّذِينَ لَمۡ
يَظۡهَرُواْ عَلَىٰ عَوۡرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضۡرِبۡنَ
بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓاْ
إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١
﴾ [النور: ٣١]
‘আর
মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের
লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের
সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত
করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর
ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক
হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ
বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের
গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা
সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’। {সূরা আন-নূর,
আয়াত : ৩১}
যেখানেই
কোনো বেগানা পুরুষ থাকবে সেখানে শরয়ী হিজাবের আটটি শর্তের কোনোটি লঙ্ঘন
করা হারাম। কেননা অনেক মহিলা ঘরের বাইরে হিজাব পরেন ঠিকই কিন্তু তারা
নিজেদের নিকটাত্মীয় গাইরে মাহরামের এর সামনে কোনো কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেন।
যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইদের সামনে মাথা ঢাকেন ঠিক কিন্তু তাদের সামনে
অন্যদের মতো পুরোপুরি পর্দা করেন না। এতে করে তারা সুস্পষ্ট গুনাহ ও হারামে
লিপ্ত হন।
পূর্ণ পর্দার শর্তগুলো নিম্নরূপ
প্রথম শর্ত : অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতে পুরো শরীর ঢাকা। ফিতনার আশংকা থাকলে সর্বসম্মতিক্রমে মুখ ও হাতের তালুদ্বয় ঢাকাও পর্দার অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় শর্ত : হিজাব নিজেই সৌন্দর্যবর্ধক না হওয়া। যেমন এতটা আকর্ষণীয় রঙের হওয়া যা সবার দৃষ্টি কাড়ে। আল্লাহ বলেন,
﴿
وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ
فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ ﴾
[النور: ٣١]
‘আর
মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের
লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের
সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না ...। {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩১}
অতএব
পর্দা যখন খোদ নিজেই সৌন্দর্যের আকার ধারণ করবে তা প্রকাশ বৈধ হবে না।
তাকে হিজাব বা পর্দাও বলা হবে না। কারণ, হিজাব তো সেটিই যা বেগানা পুরুষের
সামনে সৌন্দর্য প্রকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সুতরাং বোরকা পরেও যারা নিজের
সৌন্দর্য প্রকাশে অস্থির তারা যেন বিষয়টি ভেবে দেখেন। সত্যিকারার্থে শরঈ
পর্দা রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হয়ে তারা যেন সৌন্দর্য আড়ালকারী রঙকে
অগ্রাধিকার দেন। বলাবাহুল্য সেটি হলো কালো রঙ। পাশাপাশি তারা যেন কারুকাজ ও
জাঁকজমককেও এড়িয়ে যান।
তৃতীয় শর্ত : মোটা ও পুরু হওয়া যাতে সৌন্দর্য দৃশ্যমান না হয়। কারণ হিজাবের উদ্দেশ্য নারীর মুগ্ধ করা সৌন্দর্য পরপুরুষের আড়াল করা। অতএব পোশাক যদি আড়ালকারী না হয় তবে তাকে হিজাব আখ্যায়িত করা যায় না। কেননা আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صِنْفَانِ
مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ
كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ
عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ
الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا،
وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا»
‘জাহান্নামবাসী
দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর
লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন
নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে
নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা
জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ
এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।’ [মুসলিম : ২১২৮]
চতুর্থ শর্ত : প্রশস্ত ও ঢিলেঢালা হওয়া এবং সংকুচিত ও অন্তর্শোভা পরিদৃশ্যকারী না হওয়া। যাতে অঙ্গের আকার বা অবয়ব দৃশ্যমান না হয় এবং দেহের প্রলুব্ধকর অঙ্গ প্রস্ফুটিত না করে। এটিও পূর্বে বর্ণিত হাদীসের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চম শর্ত : কাপড় সুগন্ধিযুক্ত না হওয়া। কারণ এতে করে তা পুরুষকে আরও বেশি প্রলুব্ধ করে। নারীর আতর ব্যবহারকে ব্যভিচারের পর্যায়ে গণ্য করা হয়েছে। আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّ
عَيْنٍ زَانِيَةٌ، وَالمَرْأَةُ إِذَا اسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ
بِالمَجْلِسِ فَهِيَ كَذَا وَكَذَا» يَعْنِي زَانِيَةً «هَذَا حَدِيثٌ
حَسَنٌ صَحِيحٌ»
‘প্রতিটি
চোখই ব্যভিচারী। আর নারী যখন সুগন্ধি ব্যবহার করে জনসমাগমের পাশ দিয়ে
অতিক্রম তখন সে এটা সেটা অর্থাৎ ব্যভিচারী হয়।’ (কারণ সুগন্ধি পুরুষকে
আকর্ষণ করে তার মধ্যে কামাগ্নি জ্বালিয়ে দেয়। আর শেষাবধি এটিই তাকে
ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায়।) [তিরমিযী : ২৭৮৬]
ষষ্ঠ শর্ত : পুরুষের পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ না হওয়া। আবূ হুরায়রা রাদিয়াআল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لَعَنَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ
لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ»
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা
নারীদের পোশাক পরে এবং সেসব নারীকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের পোশাক
পরিধান করে। [আবূ দাঊদ : ৪০৯৮]
আরেক হাদীসে এসেছে, ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَرَجِّلاتِ مِنَ النِّسَاءِ، وَالْمُخَنَّثِينَ مِنَ الرِّجَالَ
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের বেশধারী নারীদের এবং নারীদের
বেশধারী পুরুষদের অভিসম্পাত করেছেন। [মুসনাদ আহমাদ : ২০০৬]
সপ্তম শর্ত : কোনো আহলে কিতাব তথা ইহুদী-খ্রিস্টান বা বিধর্মীর পোশাকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ না হওয়া। কেননা ইসলামী শরীয়ত কাফেরদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করেছে। পোশাক ও সংস্কৃতিতে তাদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করেছে। কেননা আবদুল্লাহ ইবন আমর বিন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
رَأَى
رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَلَىَّ ثَوْبَيْنِ مُعَصْفَرَيْنِ
فَقَالَ « إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ فَلاَ تَلْبَسْهَا ».
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গায়ে জাফরান ব্যবহৃত একজোড়া কাপড় দেখে বললেন, ‘এসব হলো কাফেরদের পোশাক। তাই তুমি তা পরিধান করো না।’ [মুসলিম : ৫৫৫৫]
অষ্টম শর্ত : প্রসিদ্ধি লাভের পোশাক না হওয়া। আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ
لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِي الدُّنْيَا ، أَلْبَسَهُ اللَّهُ ثَوْبَ
مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، ثُمَّ أَلْهَبَ فِيهِ نَارًا.
‘যে
ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রসিদ্ধি লাভের পোশাক পরবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে
লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। অতপর সে কাপড়ে তাকে প্রজ্বলিত করবেন।’ [ইবন মাজা :
৩৬০৭]
প্রসিদ্ধি
লাভের পোশাক সেটিই যা পরিধানের উদ্দেশ্য থাকে মানুষের নাম কুড়ানো। যেমন
অহংকারের সঙ্গে রূপের বাহার দেখিয়ে খুব দামী বস্ত্র পরিধান করা। এই শর্তটি
নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বোন, আপনি জানেন কি?
আমার
মুসলিম বোন, আপনি কি জানেন শরয়ী হিজাব কী? হিজাব কেমন হতে হবে এবং এর
শর্তাবলি কী? আর এ ব্যাপারে আপনার অজ্ঞতায় ক্ষতিই বা কী? আপনি কি পর্দা
করছেন ‘কেন হিজাব পরেছো’ এবং ‘কীভাবে হিজাব পরেছো’ সে প্রশ্নের সদুত্তর
দিয়ে পার পেতে নাকি সামাজিক রীতি হিসেবে? ঠিক বা বেঠিক যা-ই হোক
পরিপার্শ্বের প্রভাবে? আপনি কি হিজাব নিয়ে ভেবে দেখেছন কে একে ফরয করেছেন?
কেনইবা ফরয করেছেন? আর তা হওয়া চাই কেমন?
হ্যা,
আমি বিশ্বাস করতে চাই আপনি এ ব্যাপারে অজ্ঞ নন। আপনি কেন অজ্ঞ থাকবেন
যেখানে আপনাকে দেখি চাকরিক্ষেত্রে সফল পরিচালিকা, শিক্ষিকা, অধ্যাপিকা,
প্রধান শিক্ষিকা, নিয়ন্ত্রক থেকে নিয়ে ডাক্তার আর নার্স হতে। আপনাকে দেখি
মেধাবী অফিসার, জনপ্রিয় লেখক, অকুতোভয় সাংবাদিক থেকে নিয়ে দুরন্ত সব
পেশার কত কিছুই না হতে। দেখি মা, বোন, কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে অসামান্য
ভূমিকা রাখতে।
হে
খাদিজা ও খাওলার কন্যা, পর্দার ক্ষেত্রে আপনার অনমনীয়তা দেখেই কি রিপু ও
প্রবৃত্তি পূজারীরা আপনাকে নিয়ে ঠাট্টা করে? প্রতিবেশি ও আশপাশের দোকানে
দাঁড়ানো তরুণরা মশকরা করে? এর প্রভাবেই কি আপনি সব অপরিনামদর্শী ফ্যাশনের
পেছনে ছুটেন? আরও আশ্চর্য হয়ে আমাদের কোনো কোনো বোনকে দেখি, সন্ধ্যার
আগে-পরে খোলা নকশি আঁকা উজ্জ্বল গেঞ্জি, ফতুয়া বা টি-শার্ট পরে পথে
বেরিয়েছেন! ভেবে দেখুন, নিজের মধ্যে আপনি কোন গুণগুলো দেখতে চেয়েছেন আর
কোনগুলোকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন? পরিতাপের বিষয়, এমন পরিধেয়কেও আমরা অনেকে
সুশীল পোশাক বলে আখ্যায়িত করে মর্যাদা বৃদ্ধি করি!!
না, সহস্র না :
না,
সহস্র না। অজস্র না। খোদ এই গেঞ্জি, ফতুয়া আর শার্টই তো আরেক পোশাকের
অপেক্ষা রাখে। এর কমনীয়তা আড়াল করতে। এর অনাবৃতকে আবৃত করতে। এর ছিদ্র ও
ফাঁকফোকর বন্ধ করতে। যার ওপর দিয়ে বক্ষবন্ধনীর রং কিংবা নিচের সেমিসও দেখা
যায়। আল্লাহর শপথ এটি কোনো সুশীল বা মার্জিত পোশাক নয়। শালীন হতে হলে তা
হতে হবে স্পর্শকাতর ও মনোরঞ্জক সব নারী অঙ্গের আড়াল করা পোশাক। আবূ
উযাইনা ছাদফী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خَيْرُ
نِسَائِكُمُ الْوَدُودُ الْوَلُودُ الْمُوَاتِيَةُ الْمُوَاسِيَةُ، إِذَا
اتَّقَيْنَ اللهَ، وَشَرُّ نِسَائِكُمُ الْمُتَبَرِّجَاتُ
الْمُتَخَيِلَّاتُ وَهُنَّ الْمُنَافِقَاتُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ
مِنْهُنَّ، إِلَّا مِثْلُ الْغُرَابِ الْأَعْصَمِ»
‘তোমাদের
স্ত্রীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি
স্বামীকে ভক্ত করে, অধিক সন্তান জন্ম দেয় এবং (স্বামীর দুঃখে তার প্রতি)
সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল হয়। পক্ষান্তরে তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে মন্দ
তারাই, যারা বেপর্দা হয়ে দম্ভ ভরে চলে। এরাই হলো মুনাফিক। এরা জান্নাতে
প্রবেশ করবে কেবল লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের মতো। (অর্থাৎ এমন
বৈশিষ্ট্যের কাক যেমন সংখ্যায় অনেক কম তেমনি তারা কম সংখ্যক জান্নাতে
প্রবেশ করবে।) [বাইহাকী : ১৩৪৭৮]
শালীন
পোশাকের এই শর্ত পূরণ কেবল বাইরে বেরোবার সময় নয়; গৃহাভ্যন্তরে করতে
হবে। নিজেদের যথেষ্ট ধার্মিক জ্ঞানকারী কোনো কোনো পরিবারের মেয়েদের
দৃষ্টান্ত আমার সামনে উজ্জ্বল যেখানে দেখা যায় মেয়েরা বিদ্যালয়ে বা
কর্মস্থলে তথা বাইরে যাওয়ার সময় মোটামুটি পর্দার শর্ত রক্ষা আবশ্যিক
জ্ঞান করলেও মহিলা ও মাহরাম পুরুষের সামনে সংকীর্ণ পোশাক পরায় কোনো দোষ
দেখেন না। অথচ তাদের সামনেও মেয়েদের কমনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও দেহের
আকর্ষণীয় জায়গা অনাবৃত ও উন্মুক্ত করা হারাম। একটু আগেই হাদীসটি উল্লেখ
করা হয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صِنْفَانِ
مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ
كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ
عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ
الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا،
وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا»
‘জাহান্নামবাসী
দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর
লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন
নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে
নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা
জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ
এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।’ [মুসলিম : ২১২৮]
হাদীসে উল্লেখিত ‘পোশাক পরেও উলঙ্গ’–এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এমন সংক্ষিপ্ত পোশাক যা নারীর আবরণীয় অংশ ঢাকতে যথেষ্ট নয়। এমন
পাতলা পোশাক যা ভেদ করে সহজেই নারীর ত্বক দেখা যায়। এমনকি টাইট কাপড় যা
ভেদ করে ত্বক দেখা যায় না বটে তবে তা নারীর আকর্ষণীয় অবয়বকে পরিস্ফূট
করে দেয়। এসব পোশাক নারীরা কেবল তার সামনেই পরতে পারেন যার সামনে নিজের
গোপন সৌন্দর্য তুলে ধরার অনুমতি রয়েছে। বলাবাহুল্য তিনি হলেন একমাত্র
স্বামী। কেননা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো পর্দা নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ
করেন,
﴿
وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَٰفِظُونَ ٥ إِلَّا عَلَىٰٓ
أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ فَإِنَّهُمۡ غَيۡرُ
مَلُومِينَ ٦ فَمَنِ ٱبۡتَغَىٰ وَرَآءَ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ
ٱلۡعَادُونَ ٧ ﴾ [المؤمنون: ٥، ٧]
‘আর
যারা তাদের নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান
হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতঃপর
যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।’ {সূরা
আল-মু’মিনূন, আয়াত : ৫-৭}
উল্লেখিত শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, অর্থাৎ
এমন পোশাক পরিধান করে যা তাকে পুরোপুরি আবৃত করে না। ফলে কাপড় পরলেও মূলত
সে উলঙ্গই থেকে যায়। যেমন ওই নারী যে কি-না এমন পাতলা কাপড় পরে যা তার
কোমল ত্বক দৃশ্যমান করে কিংবা এমন আঁটশাট বস্ত্র গায়ে জড়ায় যা তার
শরীরের বাহু, নিতম্ব প্রভৃতির ভাঁজগুলোকে পরিষ্কার ফুটিয়ে তোলে। নারীর
পোশাক সেটিই যা তার আপাদমস্তক ঢেকে ফেলে। দেহের কোনো অংশই প্রকাশ করে না।
পুরু ও প্রশস্ত হওয়ায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকারও সুদৃশ্য করে না। [মাজুমূ‘
ফাতাওয়া : ২২/১৪৬]
হিজাব
এতদিন শিল্পিত সৌন্দর্যবিকাশ বা তরুণদের রিপু সুরসুরি দেয়ার উপাদান ছিল
না, যেমনটি আজ হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে নামকাওয়াস্তে পর্দা। তখনকার পর্দা
ছিল কেবল আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত। ছিল নারীর সম্মান ও সতীত্বের রক্ষাকবচ।
প্রিয় মুসলিম বোন, আপনি যতদিন নিজেকে আল্লাহর ফযলে পর্দাকারী দেখতে পছন্দ
করেন, নিজেকে তাদের কাতারে দেখতে চাইবেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের
সন্তুষ্টি তালাশ করে, আপনার দায়িত্ব হবে ঠিক সেভাবে বোরকা পরা যেভাবে
আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তেমন নয় যেমন যুগ চায় কিংবা আমাদের মন টানে।
আল্লাহ আপনাদের বাঞ্ছিত পদ্ধতিতে কাম্য পর্দা করবার তাওফীক দান করুন।
আমীন।
লেখক : আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সূত্র : ইসলামহাউজ
0 মন্তব্যসমূহ