আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “আর তিনিই হাসান এবং তিনিই কাঁদান। তিনিই বাঁচান এবং তিনি মৃত্যু দান করেন।” সুরা আন-নাজমঃ ৪৩-৪৪।
.
আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেন,
“আল্লাহ যদি তোমাকে কষ্ট দিতে চান, তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার মতো কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার কোন কল্যাণ করতে চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার মতো কেউ নেই।” সুরা ইউনুসঃ ১০৭।
ঈমানের ছয় নাম্বার রুকন বা স্তম্ভ হচ্ছেঃ “ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি” অর্থাৎ, আমাদের জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেনো, তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত।
.
মানুষ ঈমানদার হোক কিংবা কাফের, নেককার হোক আর পাপী বান্দা হোক, সবার জীবনে কিছু না কিছু বিপদ-আপদ আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদিও আমরা অপছন্দ করি, তারপরেও আমাদের জীবনে এমন বিপদ-আপদ কেনো আসে? আল্লাহ আমাদেরকে কেনো পরীক্ষা করেন?
.
আমাদেরকে পরীক্ষার মাঝে ফেলার পেছনে আল্লাহ তাআ’লার যে মহান হেকমতগুলো রয়েছে, নীচে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
.
(১) মানুষকে পরীক্ষা করাঃ
.
প্রকৃতপক্ষে কে ঈমানদার আর কে মুনাফেক, কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী, একথা জেনে নেওয়া। মুনাফেক ও দুর্বল ঈমানের লোকেরা অনেক সময় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে মনে রাখে, তাঁর প্রতি অনুগত ও সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু, যখন কোনো বিপদ-আপদ আসে তখন তারা আল্লাহকে ভুলে যায়, কুফুরী করে বা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। আবার অনেক সময় এর বিপরীতও হয়। যখন কোনো বিপদে পড়ে, তখন অনেক কাফের মুশরেককেও আল্লাহর কাছে মনে প্রাণে দুয়া করতে দেখা যায়। আর যখন আল্লাহ তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, তখন আল্লাহকে ভুলে যায়, তাঁর নিয়ামতকে অস্বীকার করে অহংকার প্রদর্শন করে, বলে এটাতো আমার প্রাপ্য ছিলো বা, এটা আমি আমার নিজের যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করেছি। আবার কখনো আল্লাহর সাথে শরীক করে বসে, আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণ বলে মনে করে। এই সবগুলো বিষয় নিয়ে ক্বুরআনে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, লেখাটা বড় হয়ে যাওয়ার আশংকায় সবগুলো আয়াত দেওয়া হলোনা।
.
এই বিষয়গুলো পরীক্ষা করার জন্য, অর্থাৎ কে ইখলাস বা একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে, তা পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন।
.
মহান আল্লাহ বলেন, “মানুষ কি মনে করে যে, “আমরা ঈমান এনেছি” - এ কথা বলেই অব্যহতি পেয়ে যাবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমি অবশ্যই তাদের পূর্বে যারা ছিলো তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। আর আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী, আর কারা মিথ্যাবাদী।” সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩।
অন্যত্র আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ইবাদতের উপর কায়েম থাকে। আর যদি কোনো পরীক্ষায় পড়ে তাহলে সে পূর্বাবস্থায় (কুফুরীতে) ফিরে যায়। এমন ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি। সুরা হাজ্জঃ ১১।
.
(২) দুনিয়াতেই পাপের সামান্য শাস্তি দেওয়া, যাতে করে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে ও নিজেকে পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। অনেক সময় মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, কিন্তু দুর্বল ঈমানের কারণে, পার্থিব জীবনের লোভ-লালসার শিকার হয়ে বা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর অবাধ্য হয়। আল্লাহ তখন বিপদ-আপদ দিয়ে সেই বান্দাকে অসহায় করে দেন। যাতে করে সে পরকালের কঠিন শাস্তির কথা স্বরণ করে, এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
.
আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “কঠিন শাস্তির পূর্বে আমি তাদেরকে হালকা শাস্তির আস্বাদন করাবো, যাতে করে তারা (আমার দিকে) প্রত্যাবর্তন করে।” সুরা আস-সাজদাহঃ ২১।
.
এই আয়াতে “হালকা শাস্তি” দ্বারা পার্থিব জীবনের বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, রোগ-শোক ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সুনানে নাসায়ীতে রয়েছেঃ হালকা শাস্তির অর্থ হলো দুর্ভিক্ষ। তাফসীর ইবনে কাসীর থেকে নেওয়া।
.
(৩) এছাড়া আল্লাহ তাঁর কিছু প্রিয় বান্দাকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষায় ফেলেন, যাতে করে পরকালে তার মর্যাদা ও জান্নাতের নেয়ামত বৃদ্ধি করে দিতে পারেন। অনেক সময় আল্লাহ তাঁর কোন প্রিয় বান্দাকে পরকালে উঁচু মর্যাদা দিতে চান, কিন্তু সেই বান্দা তার আমল দ্বারা সেই মর্যাদা অর্জন করার মতো যোগ্য হয়না। তখন আল্লাহ তাকে বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। সেই বান্দা যদি আল্লাহর এই পরীক্ষার ব্যপারে ধৈর্য ধারণ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে উঁচু মর্যাদা দান করেন।
.
এবার আসি, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু বিষয় নিয়ে।
.
আমরা নিজেরা যখন বিপদ আপদে পড়ি, তখন আমরা পাপী হই আর নেককার হই, আমরা কেউই কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারবোনা যে, আল্লাহ কেনো আমাদেরকে এই বিপদে ফেলেছেন। এটা কি আমাদের জন্যে কোন পরীক্ষা, নাকি এটা আমাদের কোন পাপের শাস্তি হিসেবে, এটা ‘গায়েব’ বা অদৃশ্যের জ্ঞান, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বলতে পারেনা। তাই আমরা বিপদে পড়লে কখনোই এই প্রশ্ন করবোনা, “হায় আল্লাহ! আমি কি পাপ করেছিলাম?” আর যদিও এই প্রশ্ন করি, তা নিষ্ফল। কেননা আমরা যতই নেককার হই না কেনো, আমরা কেউই পাপমুক্ত নই। আমরা জেনে কিংবা না জেনে, দিন-রাত অসংখ্য পাপ কাজ করছি। তাই আমরা এই প্রশ্ন করবোনা যে, আমি কি পাপ করেছিলাম। কিংবা, আল্লাহর পরীক্ষার ব্যপারে হতাশ হবোনা। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, অতীতের যে ভুল হয়েছে, তা তোওবা করে সংশোধন করার জন্য, আর ভবিষ্যতের জীবনকে আরো সুন্দর করার জন্য। আর এটাই হচ্ছে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য, আমাদেরকে পরীক্ষা করে আমাদেরকে সংশোধন করা। আমরা বিপদে পড়ে হতাশ হবোনা বা মনে করবোনা আমার বিপদটাই সবচাইতে বড়।
.
আমরা যদি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। অতীত থেকে ভবিষ্যত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম হয়েও, ক্বুরআনে আল্লাহ যাকে “রাহমাতুল্লিল আলামীন”, বা জগত সমূহের জন্য রহমত স্বরূপ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাঁকে একজন মানুষ হিসেবে কি পরিমাণ দুঃখ কষ্টের সময় পার করতে হয়েছিলো?
.
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে যে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে তা থেকে কিছু বর্ণনা করা হলো।
.
(১) তাঁর জীবনে তিনি তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে হারিয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে কয়জন পাঁচটা সন্তান হারিয়েছে? তিনি কি তাঁর ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসতেন না? তাঁর কি পরিমাণ কষ্ট হতো একেকটা সন্তানকে মৃত্যুর মুখে পড়তে দেখে?
.
(২) তায়েফের ময়দানে কাফের-মুশরেকদের নির্মম আচরণ সকলেরই জানা। কাফেরদের পাথর নিক্ষেপের কারণে রক্তের ধারা তাঁর মাথা থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত পৌছে যায়। এছাড়া উহুদের যুদ্ধে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। শত্রুদের তরবারির আঘাতে তাঁর মাথার বর্ম ভেঙ্গে লোহার টুকরা তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো, তাঁর একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়।
.
(৩) রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী, মা আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আ’নহার প্রতি মুনাফেকদের কর্তৃক জঘন্য অপবাদ দেয়ার সময় তাঁকে কতটুকু পেরেশানির মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়েছিলো? একেতো তিনি মুনাফেকদের শাস্তি দিতে পারছেন না, অপরদিকে তিনি তাঁর স্ত্রীর পবিত্রতা প্রমাণ করতে পারছিলেন না। ক্বুরআনের আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মা আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার পবিত্রতা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত একজন দরদী স্বামী হিসেবে তাঁকে অমানুষিক পেরেশানির মধ্যে সময় পার করতে হয়েছিলো।
.
(৪) হিজরতের পূর্বে একটানা দুইবছর তাঁকে সপরিবারে এবং তাঁর গোত্রকে একঘরে করে একটা গুহায় প্রায় বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। তৃণ ও লতা-পাতা খেয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেই সময় অমানুষিক কষ্টের মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছিলো।
.
একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, মানুষের মধ্যে কারা সবচাইতে বেশি বিপদে পড়ে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “নবী-রাসুলরা, আর এরপরে আল্লাহ যাকে যত বেশি ভালোবাসেন তাকে তত বেশি পরীক্ষায় ফেলেন।”
.
সুতরাং, বিপদে পড়লে আমাদের এই বিশ্বাস রাখা জরুরী, আমি পাপী হলেও আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন। আর এই জন্য আমাকে বিপদে ফেলে তিনি আমাকে সংশোধন করতে চাচ্ছেন, যাতে করে পরকালে যা আমদের আসল ঠিকানা, সেখানে আমাদেরকে অনন্ত সুখের জীবন দান করেন। আল্লাহর পরীক্ষা নিয়ে মূল্যবান একটি কথার দ্বারা এখানেই শেষ করছি।
.
শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-ফাউজান হা’ফিজাহুল্লাহ বলেছেন, “যখন কোন বান্দা আল্লাহর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার এটা জানা উচিত যে, আল্লাহ শুধুমাত্র তাকেই পরীক্ষা করেন নি। বরং, ইতিঃপূর্বে আল্লাহ তাঁর আওলিয়াদেরকেও পরীক্ষা করেছেন। সুতরাং বান্দার উচিত আল্লাহর পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা, পরীক্ষার ব্যাপারে ধৈর্য্য ধারণ করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বস্তি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা।” চারটি মূলনীতির ব্যাখ্যাঃ পৃষ্ঠা ৭।
.
আল্লাহ আমাকে ও আপনাদের সকলকে হক্ক পথে চলার তোওফিক দান করুন। আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত সহজ ও সুন্দর করুন, আমীন।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
.
.
(Y) শেয়ার করুন, বন্ধুদের সাথে ইন শা আল্লাহ !
_
#Islamic Thinking Bangladesh (Seeking The Way To Jannah)
0 মন্তব্যসমূহ