প্রশ্নোত্তরে হজ্জ ও উমরা (১ম পর্ব)



প্রশ্নোত্তরে হজ্জ ও উমরা

بسم الله الرحمن الرحيم

ভূমিকা

الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله
সরল ভাষায় হজ্জ ও উমরা বিষয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম অনেক আগেই। বিগত ২০০৬ এর জানুয়ারীর (১৪২৬ হিঃ) হজ্জে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজীদের কিছু ভুল-ত্রুটি আমার নযরে আসায় বইটি লিখার আগ্রহ বেড়ে যায় বহুগুণে। আল্লাহর রহমতে রেফারেন্স হিসেবে পেয়ে গেলাম ২০-এর কাছাকাছি শুধু আরবী গ্রন্থকারদের কিতাব। পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হাদীসে জিবরীলের মত এটাকে প্রশ্নোত্তর আকারে সাজালাম। পড়লে মনে হবে যেন দু'জন বসে কথা বলছেন। এদেশের হাজীদের আনুমানিক ৯৫% ভাগই সাধারণ শিক্ষিত। একটা নির্ভুল হজ্জ আদায়ের জন্য তারাই আমার এ বইয়ের প্রধান টার্গেট। প্রতিটি মাসআলা বিশুদ্ধ দলীলের ভিত্তিতে সাজাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। চারজন বিশেষজ্ঞ ফকীহসহ আরো কয়েকজন অভিজ্ঞ আলেম এর বিশুদ্ধতা যাচাই ও এ বিষয়ে সুন্দর পরামর্শ প্রদানে আমাকে সহায়তা করেছেন। তাদের পুরস্কার আল্লাহর কাছে রইল। ছোট্ট কলেবরে সর্বাধিক তথ্য দিতে চেষ্টা করেছি। বইটি যাতে সর্বমহলের কাছে সহজসাধ্য হয় সেজন্য খুব জটিল, সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও বিস্তারিত মাসআলায় যাইনি। এ বইটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হবে বিষয়বস্তুর সহজ উপস্থাপনা, অতি সহজে হজ্জ-উমরা বুঝতে পারা। অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা ও আপনাদের মূল্যবান পরামর্শ আমার কাম্য। ২০০৬ ডিসেম্বরে বইটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও বিপুল চাহিদার প্রেক্ষিতে আল্লাহর রহমতে ২০০৮ এর এপ্রিলে মাত্র দেড় বছরে চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের ও লক্ষ লক্ষ মুসলমানের উমরা ও হজ্জ কবূল করুন এবং আখিরাতে আমাদের নাজাত দিন। আমীন।

বিনীত
মোঃ নুরুল ইসলাম


সূচীপত্র 
১ হজ্জের ধারাবাহিক কাজ
২ হজ্জ ও উমরার ফযীলত
৩ হজ্জ ও উমরার আহকাম
৪ মীকাত
৫ ইহরাম
৬ মক্কায় প্রবেশ ও উমরা পালন
৭ তাওয়াফ করা
৮ সাঈ করা
৯ চুলকাটা
১০ ৮ই যিলহজ্জ তারিখের কাজ
১১ আরাফাতের মাঠে অবস্থান
১২ মুযদালিফায় রাত্রি যাপন
১৩ কংকর নিক্ষেপ
১৪ হাদী (পশু জবাই), কুরবানী, দম
১৫ তাওয়াফে ইফাদা
১৬ মিনায় রাত্রিযাপন
১৭ বিবিধ মাসআলা
১৮ বিদায়ী তাওয়াফ
১৯ মসজিদে নববী যিয়ারত
২০ সফরের আদব
২১ কুরআনে বর্ণিত দোয়া
২২ হাদীসে শিখানো দোয়া
২৩ তথ্যপুঞ্জি

১ম অধ্যায়
হজ্জের ধারাবাহিক কাজ
তারিখ
স্থান
করণীয় ইবাদত
৮ই যিলহজ্জের পূর্বের কাজ
মীকাত
(১) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধবেন।
মক্কা
(২) কাবা ঘরে উমরার তাওয়াফ করবেন।
(৩) সাঈ করবেন।
(৪) চুল কেটে হালাল হয়ে যাবেন।
হজ্জের ধারাবাহিক কাজ
৮ই যিলহজ্জ (তারউইয়্যার দিন)
মিনা
নিজ বাসস্থান থেকে ইহরাম বেঁধে হজ্জের নিয়ত করে সূর্যোদয়ের পর মিনায় রওয়ানা হবেন। সেখানে যুহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের সালাত আদায় করবেন।
৯ই যিলহজ্জ
(আরাফার দিন)
আরাফা ময়দান
(১) সূর্যোদয়ের পর আরাফাতে রওয়ানা হবেন।
(২) যুহরের প্রথম ওয়াক্তে যুহর ও আসর পড়বেন একত্রে পরপর দুই দুই রাকআত করে।
(৩) সূর্যাস্তের পর মুযদালিফায় রওয়ানা করবেন। মাগরিব-এশা সেখানেই পড়বেন।
(৪) সেখানে রাত্রি যাপন করে প্রথম ওয়াক্তে অন্ধকার থাকতেই ফজর পড়বেন।
(৫) আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত কেবলামুখী হয়ে হাত তুলে দীর্ঘ সময় দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল থাকবেন।
(৬) বড় জামারায় নিক্ষেপের জন্য ৭টি কংকর এখান থেকে কুড়াতে পারেন।
তারিখ
স্থান
করণীয় ইবাদত
১০ ই যিলহজ্জ (ঈদের দিন)
মিনা
(১) বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন।
(২) কুরবানী করবেন।
(৩) চুল কাটাবেন। অতঃপর ইহরামের কাপড় বদলিয়ে সাধারণ পোষাক পরে ফেলবেন।
মক্কা
(৪) তাওয়াফে ইফাদা করবেন। এদিন না পারলে এটি ১১ বা ১২ তারিখেও করতে পারবেন এবং তৎসঙ্গে সাঈও করবেন।
১১ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)
১ম দিন
মিনা
(১) দুপুরের পর সিরিয়াল ঠিক রেখে প্রথমে ছোট, মধ্যম ও এর পরে বড় জামরায় প্রত্যেকটিতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন।
(২) মিনায় রাত্রি যাপন করবেন।
১২ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)
২য় দিন
মিনা
(১) পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী ৩টি জামরায় ৭+৭+৭=২১টি কংকর নিক্ষেপ করবেন। দুপুরের আগে কংকর নিক্ষেপ করবেন না।
(২) সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করবেন। তা না পারলে আজ দিবাগত রাতও মিনায় কাটাবেন।
১৩ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)
৩য় দিন
মিনা
(১) যারা গত রাত মিনায় কাটিয়েছেন তারা আজ দুপুরের পর পূর্ব দিনের নিয়মেই ৭টি করে মোট ২১ টি কংকর মারবেন। অতঃপর মিনা ত্যাগ করবেন।
অতঃপর
মাক্কাহ
দেশে ফেরার পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।


২য় অধ্যায়
فضل الحج والعمرة
হজ্জ ও উমরার ফযীলত

প্রঃ ১-হজ্জ ও উমরা পালনকারীকে আল্লাহ তা'আলা কি কি প্রতিদান দেবেন?
উঃ হজ্জ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি স্তম্ভ। এ হজ্জ ও উমরা পালনে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়া ও পরপারের জন্য অনেক প্রতিদান রয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু হাদীস উল্লেখ করা হলো :
(ক) হজ্জ পালন উত্তম ইবাদাত
১-عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سُئِلَ النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- أَيُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ إِيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهৃ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ جِهَادٌ فِي سَبِيلِ اللهِ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ حَجٌّ مَبْرُورٌ.
(১) আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা সর্বোত্তম আমল কোনটি? জবাবে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলোঃ তারপর কোন আমল? তিনি উত্তর দিলেন, "আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আবার জিজ্ঞাস করা হলোঃ এরপর কোন আমল? জবাবে তিনি বললেন, "মাবরূর হজ্জ" (কবূল হজ্জ)* (বুখারী ২৬, ১৫১৯ ও মুসলিম ৮৩)
(খ) হাজীগণ আল্লাহর মেহমান
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللهِ وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ وَفْدُ اللهِ دَعَاهُمْ فَأَجَابُوهُ وَسَأَلُوهُ فَأَعْطَاهُمْ
(২) ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং হজ্জ ও উমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তারা আল্লাহর কাছে যা চাইছে আল্লাহ তাই তাদের দিয়ে দিচ্ছেন। (ইবনে মাজাহ ২৮৯৩)
৩- إِنْ دَعَوْهُ أَجَابَهُمْ وَإِنِ اسْتَغْفَرُوهُ غَفَرَ لَهُمْ
(৩) অন্য হাদীসে আছে, হজ্জ ও উমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা দোয়া করলে তা কবূল হয়ে যায় এবং গুনাহ মাফ চাইলে তা মাফ করে দেয়। (ইবনে মাজাহ ২৮৯২)
(৪) তিন ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান : ক) হাজী খ) উমরা পালনকারী গ) আল্লাহর পথে জিহাদকারী। (নাসাঈ)
(গ) হজ্জ জিহাদতুল্য ইবাদাত
-عن الحسن بن علي رضي الله عنهما قال جَاءَ رجلا إلى النبي -صلى الله عليه وسلم- فقال : إني جبان، وإني ضعيف، فقال : هلم إلى جهاد لا شوكة فيه : الحج - الطبراني
(৫) হাসান ইবনু আলী রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে আরজ করল আমি একজন ভীতু ও দুর্বল ব্যক্তি। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি এমন একটি জিহাদে চলো যা কণ্টকাকীর্ণ নয় (অর্থাৎ হজ্জ পালন করতে চলো।) (তাবারানী)
৬- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللهِ -صلى الله عليه وسلم-قَالَ جِهَادُ الْكَبِيرِ وَالصَّغِيرِ وَالضَّعِيفِ وَالْمَرْأَةِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ
(৬) আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "বয়স্ক, শিশু, দুর্বল ও নারীর জিহাদ হলো হজ্জ এবং উমরা পালন করা"। (নাসাঈ ২৬২৬)
৭- وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ : يَا رَسُوْلَ اللهِ، تري الجهادَ أَفْضَلُ الْعَمَلِ، أَفَلاَ نُجَاهِدُ، لَكُنَّ أَفْضَلُ الْجِهَادِ : حَجِّ مَبْرُوْرِ- (رواه البخاري ومسلم)
(৭) আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করেন। আমরা (নারীরা) কি জিহাদ করতে পারব না? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হলো মাবরূর হজ্জ (কবূল হজ্জ)।" (বুখারী ও মুসলিম)
(৮) অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
৮- عَلَيْهِنَّ جِهَادٌ لاَ قِتَالَ فِيهِ الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ
"হা, নারীদের উপর জিহাদ ফরয। তবে এ জিহাদে কোন মারামারি ও সংঘাত নেই। আর সেটা হলোঃ হজ্জ ও উমরা পালন করা। (আহমাদ ২৪৭৯৪)
(ঘ) হজ্জ গুনাহমুক্ত করে দেয়
৯- عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ : قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم-يَقُولُ : مَنْ حَجَّ للهِস্ট فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهচ্
(৯) আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, " যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহকে খুশী করার জন্য হজ্জ করল এবং হজ্জকালে যৌন সম্ভোগ ও কোন প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হল না সে যেন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার দিনের মতই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ী ফিরল। (বুখারী : ১৫২১)
১০- أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ
(১০) আমর ইবনুল আসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, তুমি কি জান না ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তদ্রূপ হিজরতকারীর আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং হজ্জ পালনকারীও পূর্বের গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। (মুসলিম ১২১)
১১- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم-تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
(১১) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "তোমরা হজ্জ ও উমরা পালন কর। কেননা হজ্জ ও উমরা উভয়টি দারীদ্রতা ও পাপরাশিকে দূরীভূত করে যেমনিভাবে রেত স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহার মরিচা দূর করে দেয়। আর মাবরূর হজ্জের বদলা হল জান্নাত।" (তিরমিযী ৮১০)
(ঙ) হজ্জের বিনিময় হবে বেহেশত
১২ عن جابر : : أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم-قال : هذا البيت دعامة الإسلام، فمن خرج يؤم هذا البيت من حاج أو معتمر، كان مضمونا على الله إن قبض أن يدخله الجنة وإن رده رده بأجر وغنيمة
(১২) জাবের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "এ (কাবা) ঘর ইসলামের স্তম্ভস্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি হজ্জ কিংবা উমরা পালনের জন্য এ ঘরের উদ্দেশ্যে বের হবে সে আল্লাহ তা'আলার যিম্মাদারীতে থাকবে। এ পথে তার মৃত্যু হলে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আর বাড়ীতে ফিরে আসার তাওফীক দিলে তাকে প্রতিদান ও গণীমত দিয়ে প্রত্যার্বতন করাবেন।
১৩- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ رَسُولَ اللهِ -صلى الله عليه وسلم-قَالَ الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ
(১৩) আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক উমরা থেকে অপর উমরা পালন করার মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে হয়ে যাওয়া পাপরাশি এমনিতেই মাফ হয়ে যায়। আর মাবরূর হজ্জের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত। (বুখারী ১৭৭৩)
(চ) হজ্জে খরচ করার ফযীলত
১৪- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- النَّفَقَةُ فِي الْحَجِّ كَالنَّفَقَةِ فِي سَبِيلِ اللهِ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
(১৪) বুরাইদা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হজ্জে খরচ করা আল্লাহর পথে (জিহাদে) খরচ করার সমতূল্য সাওয়াব। হজ্জে খরচকৃত সম্পদকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে এর প্রতিদান দেয়া হবে। (আহমাদ ২২৪৯১)
(ছ) অন্যান্য প্রতিদান
(১৫) আয়েশাˆ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফাতের দিন এত অধিক সংখ্যক লোককে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য কোন দিন দেন না। এরপর তিনি (হাজীদের) নিকটবর্তী হয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, এরা কি চায়? (অর্থাৎ হাজীরা যা চাচ্ছে তা তাদেরকে দিয়ে দেয়া হল।) (মুসলিম)
(১৬) সর্বোত্তম দোয়া হল আরাফার দিনের দোয়া। (তিরমিযী)
(১৭) রমযান মাসের উমরা পালন করা আমার সাথে (অর্থাৎ নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে) হজ্জ করার সমতূল্য। (বুখারী)
(১৮) হাজ্‌রে আস্‌ওয়াদ ও রুক্‌নে ইয়ামানী স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যে ব্যক্তি কাবা ঘর সাতবার তাওয়াফ করে দু'রাকাত সালাত আদায় করে সে যেন একটি গোলাম আযাদ করল। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে গিয়ে যে ব্যক্তি একটি পা মাটিতে রাখল, আবার এটি উঠাল এর প্রত্যেকটির জন্য তাকে ১০টি সাওয়াব, ১০টি গুনাহ মাফ এবং তার ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। (আহমাদ)
(১৯) মসজিদুল হারামে একবার সালাত আদায় করা অন্য মসজিদে (মাসজিদে নববী ব্যতীত) এক লক্ষ বার সালাত আদায়ের চেয়েও বেশী সাওয়াব। (আহমাদ)

৩য় অধ্যায়
أحكام الحج والعمرة
হজ্জ ও উমরার আহকাম

প্রঃ ২- উমরার রুকন কয়টি ও কি কি?
উঃ- ১টি। সেটি হলো কাবাঘর তাওয়াফ করা। আর উমরার শর্ত হলো ইহরাম বাঁধা।[১] তবে কেউ কেউ বলেছেন উমরার রুকন তিনটি। যথা :
(১) ইহরাম বাঁধা।
(২) তাওয়াফ করা
(৩) সাঈ করা।
উল্লেখ্য যে, এ রুকনগুলোই উমরার ফরয।
প্রঃ ৩- উমরার ওয়াজিব কয়টি ও কি কি?
উঃ- ৩টি, সেগুলো হল :
(১) ইহরামের কাপড় পরে উমরার নিয়ত করার কাজটি মীকাত পার হওয়ার আগেই করা।
(২) 'সাফা ও মারওয়া' এ দু'টি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ করা। কিছু আলেম একে রুকন অর্থাৎ ফরয বলেছেন।
(৩) চুল কাটা (মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা)।
প্রঃ ৪- উমরা করার হুকুম কি?
উঃ- হানাফী ও মালেকী মাযহাবে উমরা করা সুন্নাত। আর শাফী ও হাম্বলী মাযহাবে উমরা করা ফরয। অর্থাৎ যার উপর হজ্জ ফরয তার উপর উমরাও ফরয।
প্রঃ ৫- উমরার মৌসুম কখন?
উঃ- উমরা বৎসরের যেকোন মাস, যে কোন দিন ও যে কোন রাতে করা যায়। তবে ইমাম আবু হানীফার মতে আরাফাতের দিন, কুরবানীর দিন এবং আইয়ামে তাশরীকের তিন দিন উমরা করা মাকরূহ।
প্রঃ ৬- হজ্জের রুকন কয়টি ও কি কি?
উঃ- ৩টি, যথা :
(১) ইহরাম বাঁধা (অর্থাৎ ইহরামের কাপড় পরে হজ্জের নিয়ত করা।)
(২) ৯ই যিলহজ্জে আরাফাতে অবস্থান করা।
(৩) তাওয়াফ : তাওয়াফে ইফাদা অর্থাৎ তাওয়াফে যিয়ারাহ করা।
উল্লেখ্য যে, হজ্জের রুকনগুলোই মূলতঃ হজ্জের ফরয। এর কোন একটি রুকন ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
প্রঃ ৭। হজ্জের ওয়াজিব কয়টি ও কি কি?
উঃ- ৯টি, সেগুলো হল :
(১) সাঈ করা। (অনেকের মতে এটা হজ্জের রুকন।)
(২) ইহরাম বাঁধার কাজটি মীকাত পার হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা।
(৩) আরাফাতে অবস্থান সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা।
(৪) মুযদালিফায় রাত্রি যাপন।
(৫) মুযদালিফার পর কমপক্ষে দুই রাত্রি মিনায় যাপন করা।
(৬) কঙ্কর নিক্ষেপ করা।
(৭) হাদী (পশু) জবাই করা (তামাত্তু ও কেরান হাজীদের জন্য।)
(৮) চুল কাটা।
(৯) বিদায়ী তাওয়াফ।
প্রঃ ৮:- দম কী কারণে দিতে হয়?
উঃ- যে কোন কারণেই হোক উপরে বর্ণিত কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে দম (অর্থাৎ পশু জবাই) দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
প্রঃ ৯:- হজ্জের সুন্নত কয়টি ও কী কী?
উঃ- হজ্জের সুন্নত অনেক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: (১) ইহরামের পূর্বে গোসল করা (২) পুরুষদের সাদা রঙের ইহরামের কাপড় পরিধান করা। (৩) তালবিয়াহ পাঠ করা (৪) ৮ই যিলহজ্জ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা (৫) ছোট ও মধ্যম জামারায় কংকর নিক্ষেপের পর দু'আ করা (৬) কেরান ও ইফরাদ হাজীদের তাওয়াফে কুদূম করা।
তবে কোন কারণে সুন্নত ছুটে গেলে দম দিতে হয় না।
প্রঃ ১০:- হজ্জ কত প্রকার ও কি কি?
উঃ- ৩ প্রকার, যথা :
(১) তামাত্তু, (২) কেরান, (৩) ইফরাদ।
প্রথমত : 'তামাত্তু' হল হজ্জের সময় প্রথমে উমরা করে হালাল হয়ে ইহরামের কাপড় বদলিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। এর কিছু দিন পর আবার মক্কা থেকেই ইহরাম বেধে হজ্জের আহকাম পালন করা।
দ্বিতীয়ত : 'কিরান' হল উমরা ও হজ্জের মাঝখানে হালাল না হওয়া এবং ইহরামের কাপড় না খোলা। একই ইহরামে আবার হজ্জ সম্পাদন করা।
তৃতীয়ত : 'ইফরাদ' হল উমরা করা ছাড়াই শুধুমাত্র হজ্জ করা।
প্রঃ ১১। হজ্জ ফরয হওয়ার দলীল কি?
উঃ- প্রথমতঃ আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ। তিনি বলেনঃ
وَلِلَّهِ على الناس حج البيت من استطاع إليه سبيلا
অর্থ : মানুষের মধ্যে যার সামর্থ আছে আল্লাহর জন্য ঐ ঘরে হজ্জ করা তার উপর অবশ্য কর্তব্য।[২]
দ্বিতীয়তঃ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস। তিনি বলেন :
(ক) ইসলামের ভিত্তি হয়েছে ৫টি স্তম্ভের উপর :
(১) আল্লাহ ছাড়া কোন মা'বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া,
(২) সালাত আদায় করা,
(৩) যাকাত দেয়া,
(৪) রমজান মাসে সিয়াম পালন করা এবং
(৫) বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্জ পালন করা। (বুখারী)
(খ) হে মানুষেরা! আল্লাহ তোমাদের উপর হজ্জ ফরয করেছেন। কাজেই তোমরা হজ্জ পালন কর। (মুসলিম)
প্রঃ ১২- কোন কোন শর্ত পূরণ হলে একজন লোকের উপর হজ্জ ফরয হয়?
উঃ- নিম্ন বর্ণিত শর্তগুলোর সবকটি পূরণ হলে হজ্জ ফরয হয় :
(১) মুসলমান হওয়া। অমুসলিম অবস্থায় কোন ইবাদাত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
(২) বালেগ হওয়া।
(৩) আকল-বুদ্ধি থাকা। অর্থাৎ অজ্ঞান ও পাগলের কোন ইবাদাত হয় না।
(৪) আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতা থাকা। আর্থিক সক্ষমতার অর্থ হলো হজ্জের খরচ বহন করার পর তার পরিবারের ভরণপোষণ চালিয়ে যাওয়ার মত সম্পদ ও সক্ষমতা থাকতে হবে। শারীরিক সুস্থতার সাথে তার যানবাহনের সুবিধা, পথের নিরাপত্তা থাকা এবং মহিলা হলে তার সাথে মাহ্‌রাম পুরুষ থাকা এসবও সক্ষমতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এর কোন একটির ব্যাঘাত ঘটলে হজ্জ ফরয হবে না।
প্রঃ ১৩- যার উপর হজ্জ ফরয হয় তিনি কতদিন পর্যন্ত দেরী করতে পারবেন?
উঃ- সাথে সাথেই হজ্জ আদায় করতে হবে। দেরী করা উচিত নয়। কারণ, যে কোন সময় বিপদাপদ এমন কি মৃত্যু এসে যেতে পারে। অধিকাংশ ওলামাদের মত এটাই।
প্রঃ ১৪- ইবাদাত কবূলের শর্ত কয়টি ও কি কি?
উঃ- ইবাদাত কবূলের শর্ত ৪টি, যথা :
(১) ঈমান থাকা : অর্থাৎ কাফির ও মুশরিক থাকা অবস্থায় কোন ইবাদাত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানের প্রতি সন্দেহ পোষণ করবে তাদেরও কোন ভাল কাজ ইবাদাত হিসেবে গৃহীত হবে না।
(২) ইখলাস : অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির প্রতিটি ভাল কাজ শুধুমাত্র আল্লাহ তা'আলাকে খুশী করার জন্য করতে হবে। অন্য কোন স্বার্থে তা করলে ইবাদাতের কাজটিও ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে না। এমনকি কেউ যদি নিয়ত করে, আল্লাহও খুশী হবেন সাথে সাথে দুনিয়াবী একটি স্বার্থও হাসিল হবে, এ দুই নিয়ত একত্র করলে এটা ইবাদাত হিসেবে কবূল হবে না। সকল প্রকার ইবাদাত ও ভাল কাজ একমাত্র আল্লাহ তা'আলাকে খুশী করার নিয়তে করতে হবে। এটাকেই বলা হয় ইখলাস।
৩। সুন্নাত তরীকা : জীবনের সকল কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নত তরীকায় করতে হবে। তবেই এটা ইবাদাত বলে গণ্য হবে, নতুবা নয়। বিশুদ্ধ দলীল ছাড়া বা মনগড়া কিছুই করা যাবে না। পূর্ব থেকে চলে আসছে, রেওয়াজ আছে অথচ এর পক্ষে সহীহ শুদ্ধ দলীল নেই এমন কিছুই করা যাবে না। করলে তা ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে না। সাওয়াবতো হবেই না। টয়লেট ব্যবহার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত আপনি যে কাজটাই নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত তরীকায় করবেন সেটাই ইবাদাত হয়ে যাবে এবং পরকালে এর সাওয়াব পাবেন।
৪। শির্কমুক্ত থাকা : সর্বাবস্থায় আপনাকে শির্কমুক্ত থাকতে হবে। কারণ শির্ক করলে ইবাদাত বাতিল হয়ে যায়। (সূরা যুমার : ৬৫) যে মুসলমান শির্ক করবে বেহেশত চিরকালের তরে তার জন্য হারাম হয়ে যায়। (সূরা মায়েদা : ৭২, সূরা হজ্জ : ৩১, সূরা নিসা : ৪৮, সূরা ইউসুফ : ১০৬।
যেসব কাজ করলে বড় শির্ক হয় এর কিছু দৃষ্টান্ত নীচে দেয়া হল।
কবরে মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া, বিপদ মুক্তি কামনা বা সন্তান চাওয়া। মাযারে বা কোন মানুষকে সেজদা করা। আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে মানুষের নির্দেশ মান্য করা। পীরের উপর ভরসা করা, গণকের কথায় বিশ্বাস করা। আলিমুল গায়েব হলেন একমাত্র আল্লাহ, কোন পীর গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, যাদু করা, তাবীজ পরা ইত্যাদি। এগুলো ছাড়া আরো অনেক বড় শির্ক আছে। আর ছোট শির্কতো আছেই। এগুলো সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। তাওবাহ করে পাকসাফ হতে হবে।
উপরে বর্ণিত ৪টি শর্তের একটি শর্তও যদি বাদ পড়ে যায় তাহলে বান্দার ইবাদাত বাতিল হয়ে যাবে। যতলক্ষ টাকাই হজ্জে খরচ করা হোক না কেন এর কোন সাওয়াব পাওয়া যাবে না। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মানুষের কাছে পৌছিয়ে দেয়া আমাদের সকলের উপর অবশ্য কর্তব্য।

৪র্থ অধ্যায়
ميقات
 মীকাত

প্রঃ ১৫- মীকাত কি?
উঃ- কাবা শরীফ গমনকারীদেরকে কাবা হতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, যে স্থানগুলো নবীজির হাদীস দ্বারা নির্ধারিত আছে। ঐ জায়গাগুলোকে মীকাত বলা হয়। হারাম শরীফের চর্তুদিকেই মীকাত রয়েছে।
প্রঃ ১৬- মীকাত কত প্রকার ও কি কি?
উঃ- ২ প্রকার : (ক) সময়ের মীকাত, (খ) স্থানের মীকাত। হজ্জের জন্য সময়ের মীকাত হল শাওয়াল, যিলকদ এবং যিলহজ্জ মাস। অনেকের মতে শাওয়াল মাস থেকে যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিন পর্যন্ত। এ সময়গুলোকে হজ্জের মাস বলা হয়। অপরদিকে উমরার সময় হল বছরের যে কোন মাস, দিন ও রাত।

প্রঃ ১৭- স্থানগত মীকাত কয়টি ও কি কি?
উঃ ৫টি মীকাত।
১। মদীনাবাসীদের জন্য যুল হুলাইফা ذو الحليفة
২। সিরিয়াবাসীদের জন্য আল-জুহফা الجحفة
৩। নজদবাসীদের জন্য কারনুল মানাযিল قرن المنازل
৪। ইয়ামানবাসীদের জন্য ইয়ালামলাম يلملم
৫। ইরাকবাসীদের জন্য যাতুইরক ذات عرق
প্রঃ ১৮- বাংলাদেশ থেকে যারা উমরা বা হজ্জে যাবেন তারা কোন স্থান থেকে ইহরাম বাঁধবেন?
উঃ- উপরে বর্ণিত চতুর্থ মীকাত 'ইয়ালামলাম' নামক স্থান থেকে। আকাশ পথে বিমান যখন উক্ত মীকাতে পৌছে তখন ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, তখনই ইহরাম বাধবে অর্থাৎ নিয়ত করবে। ঢাকা থেকেও ইহরামের কাপড় পরে যাওয়া যায়। তবে নিয়ত করবেন 'মীকাতে' পৌঁছে বা এর পূর্বক্ষণে। মনে রাখতে হবে যে, ইহরাম বাঁধা ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা যাবে না। ইহরাম বাঁধার অর্থ হল ইহরামের কাপড় পরে উমরা বা হজ্জের নিয়ত করা।
প্রঃ ১৯- প্রথম মীকাত (ذو الحليفة) যুলহুলাইফা নামক স্থানটি কোথায়? এখান থেকে কোন কোন এলাকার লোকেরা ইহরাম বাঁধবে?
উঃ- এস্থানটি এখন (أَبيَارِ عَلِيٍّ) 'আবইয়ারে আলী' নামে পরিচিত। এটি মসজিদে নববী থেকে ১৩ কিলোমিটার এবং মক্কা শহর থেকে ৪২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মদীনাবাসী এবং এ পথ দিয়ে যারা আসে তারা এখান থেকে ইহরাম বাধবে। মক্কা শহর থেকে এটাই সবচেয়ে দূরতম মীকাত।
প্রঃ ২০- দ্বিতীয় মীকাত (الجحفة) আলজুহফা নামক স্থানটি কোথায়? এখান থেকে কোন দেশের লোকেরা ইহরাম বাঁধে?
উঃ- এ জায়গাটি লোহিত সাগর থেকে ১০ কিলোমিটার ভিতরে (رابغ) 'রাবেগ' শহরের কাছে। জুহফাতে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় 'রাবেগ' নামক স্থান থেকে এখন লোকেরা ইহরাম পরে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ এখন এটি একটি বড় শহর। জম্মুম উপত্যকার পথ ধরে মক্কা শহর থেকে এ স্থানটি ১৮৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেসব দেশের লোকেরা এখান থেকে ইহরাম পরিধান করে তা হল :
(ক) সিরিয়া, (খ) লেবানন, (গ) জর্দান, (ঘ) ফিলিস্তীন, (ঙ) মিশর, (চ) সূদান, (ছ) মরক্কো, (জ) আফ্রীকার দেশসমূহ (ঝ) সৌদী আরবের উত্তরাঞ্চলীয় কিছু এলাকা এবং (ঞ) মদীনার পথ ধরে যারা আসে না তারাও এখান থেকে ইহরাম বাঁধে।
প্রঃ ২১- তৃতীয় মীকাত (قرن المنازل) 'কারনুল মানাযিল' কোথায়? এবং এটা কোন এলাকার লোকদের মীকাত?
উঃ- কারনুল মানাযিল (قَرْنُ الْمَنَازِل) স্থানটি এখন (السيل الكبير) "সাইলুল কাবীর" নামে প্রসিদ্ধ। সরকারী বেসরকারী অফিস আদালতসহ এটি এখন একটা বড় গ্রাম। মক্কা থেকে এর দূরত্ব ৭৮ কিলোমিটার। যেসব এলাকা ও দেশের লোকেরা এখান থেকে ইহরাম বাঁধে সেগুলো হল : (ক) রিয়াদ, দাম্মাম ও তায়েফ (খ) কাতার (গ) কুয়েত (ঘ) আরব আমীরাত (ঙ) বাহরাইন (চ) ওমান (ছ) ইরাক, (জ) ইরানসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ এবং এ পথ দিয়ে যারা আসে।
প্রঃ ২২- কারনুল মানাযিলের অন্তর্ভুক্ত (وادي محرم) "ওয়াদী মুহরিম" নামে ২য় আরেকটি স্থান থেকে লোকেরা ইহরাম বাঁধে। এটি কোথায় এবং কেমন?
উঃ- এটা তায়েফ-মক্কা রোডে 'হাদা' এলাকা হয়ে মক্কা শরীফ গমনের পথে মক্কা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে সর্বাধুনিক ও বৃহদাকার মসজিদ, অজু-গোসল ও গাড়ী পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত সুবিধাদি রয়েছে। এটা নতুন কোন মীকাত নয়, এটি কারনুল মানাযিলেরই অংশ বিশেষ।
প্রঃ ২৩- চতুর্থ মীকাত "ইয়ালামলাম" (يلملم) যেখানে বাংলাদেশ থেকে গমনকারী লোকেরা ইহরাম বাঁধে- এটির অবস্থান কোথায় এবং কেমন?
উঃ- 'ইয়ালামলাম' শব্দটি একটি উপত্যাকার নাম বলে জানা যায়। এ জায়গাটি মক্কা শরীফ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এলাকাটি السعدية 'সাদীয়া' নামেও পরিচিত। যেসব দেশের লোকেরা এখান থেকে ইহরাম বাঁধে সেগুলো হল : (ক) ইয়ামেন, (খ) বাংলাদেশ, (গ) ভারতবর্ষ, (ঘ) চীন, (ঙ) ইন্দোনেশিয়া, (চ) মালয়েশিয়া, (ছ) দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্বের দেশসমূহ।
প্রঃ ২৪- পঞ্চম মীকাতটি কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে?
উঃ- পঞ্চম মীকাতটির নাম (ذات عرق) 'যাতুইরক'। এটা মক্কা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট না থাকায় এটি এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এটা ছিল ইরাকবাসীদের মীকাত। তারা এখন তৃতীয় মীকাত 'সাইলুল কাবীর' ব্যবহার করে।
প্রঃ ২৫- যেসব এলাকার লোক এসবের কোন একটি মীকাতের ডান বা বাম পাশ দিয়ে যাবে, তারা কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?
উঃ- নিকটস্থ প্রথম মীকাতের পাশ দিয়ে যখন যাবে তখনই ইহরাম বাধবে।
প্রঃ ২৬- বর্ণিত ৫টি মীকাতের সীমানার ভিতরে যারা বসবাস করে যেমন জেদ্দা, বাহরা, তায়েফ, শরাইয় ও মক্কার মধ্যবর্তী এলাকার বাসিন্দাগণ বা চাকুরীরত বিদেশীরা কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?
উঃ- হজ্জের জন্য তারা তাদের নিজেদের ঘর থেকেই ইহরাম বাধবে। তাদেরকে মীকাতে যেতে হবে না।
প্রঃ ২৭- মীকাতের ভিতরে ও বাহিরে উভয় জায়গায় যাদের বাড়ী আছে তারা কোথা থেকে ইহরাম বাধবে?
উঃ- যে কোন একটা স্থান থেকেই ইহরাম বাঁধা যাবে। এ বিষয়ে তারা স্বাধীন।
প্রঃ২৮- মক্কাবাসীগণ কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?
উঃ-হজ্জের ইহরাম হলে নিজ নিজ ঘর থেকে, আর উমরার ইহরাম হলে মসজিদে তানয়ীমে যাবে অথবা হারামের হুদুদের (সীমানার) বাইরে যে কোন স্থানে গিয়ে বাঁধবে। মক্কায় চাকরীরত বিদেশীরাও তাই করবে।
প্রঃ ২৯- ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করার হুকুম কি?
উঃ- এটা হারাম। তবে শুধুমাত্র চাকুরী, ব্যবসা, চিকিৎসা, পড়াশুনা, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানো বা অন্যকোন কারণে মক্কা শরীফ প্রবেশ করলে ইহরাম বাঁধা জরুরী নয়। কিন্তু ইহরাম পরে উমরা করে নিলে ভাল হয়। দলীল :
فَهُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ[৩]
প্রঃ ৩০- ইহরামের কাপড় পরিধান ছাড়া জেনে বা অজ্ঞতাবশতঃ, সজ্ঞানে, ভুলে বা ঘুমন্ত অবস্থায় মীকাতের সীমানায় ঢুকে পড়লে কি করতে হবে?
উঃ- তাকে অবশ্যই আবার মীকাতে ফিরে গিয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে, নতুবা একটি দম দিতে হবে অর্থাৎ একটি ছাগল, বকরী বা দুম্বা জবাই করে মক্কায় গরীবদের মধ্যে এর গোশত বিলি করে দিতে হবে। নিজে খেতে পারবে না।
প্রঃ ৩১- মীকাত পার হওয়ার আগে কী কী কাজ করতে হয়?
উঃ-মীকাতে নিম্ন বর্ণিত কাজ করার বিধান রয়েছে :
(১)নখ ও চুল কেটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া মুস্তাহাব।
(২)মুস্তাহাব হলো গোসল করে নেয়া।
(৩) সুগন্ধি মাখাও মুস্তাহাব। তবে মেয়েরা সুগন্ধি মাখবে না।
(৪) ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ ইহরামের কাপড় পরে উমরা বা হজ্জের নিয়ত করা। এটি ওয়াজিব।
ফর্মা-৩

(৫) মেয়েদের হায়েয অবস্থায়ও মীকাত পার হওয়ার আগে গোসল করে ইহরাম পরা সুন্নাত। অতঃপর হজ্জ বা উমরার নিয়ত করা।
(৬) মুস্তাহাব হলো ফরয সালাতের পর ইহরাম বাঁধা।
(৭) দু'রাকআত সালাত (তাহিয়্যাতুল অজু) শেষ হলে নিয়ত করবেন।
(৮) অতঃপর তালবিয়াহ পাঠ শুরু করবে। এটি নীচে দেয়া হল :
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ - لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ু إِنَّ الْحَمْدَ - وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ - لاَ شَرِيكَ لَكَ
অর্থ : হাজির হয়েছি হে আল্লাহ! তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হয়েছি। আমি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার কোন শরীক নাই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোন শরীক নাই।

৫ম অধ্যায়
 إحرام
ইহরাম

প্রঃ ৩২- ইহরামের কাপড় পরিধানের পূর্বে পরিচ্ছন্নতার জন্য কি কি কাজ করা মুস্তাহাব?
উঃ- নখ কাটা, গোফ খাট করা, বোগল ও নাভির নীচের চুল কামানো ও তা পরিষ্কার করা। তবে ইহরামের পূর্বে পুরুষ ও মহিলাদের মাথার চুল কাটার বিষয়ে কোন বিধান পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য যে, দাড়ি কোন অবস্থায়ই কাটা যাবে না। নখ-চুল কাটার পর গোসল করাও মুস্তাহাব।
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ وَتَقْلِيمِ الأَظْفَارِ وَنَتْفِ الإبِطِ وَحَلْقِ الْعَانَةِ أَنْ لاَ نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
গোঁফ ছোট করা, নখ কাটা, বগল পরিষ্কার করা এবং নাভির নীচের লোম পরিষ্কার করার কাজগুলোকে ৪০ রাতের বেশি সময় অতিক্রম না করার জন্য আমাদেরকে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। (মুসলিম ২৫৮)
প্রঃ ৩৩- ইহরামের কাপড় পরিধানের পূর্বে সুগন্ধি মাখা মুস্তাহাব। কিন্তু এ সুগন্ধি কোথায় মাখতে হবে?
উঃ- মাথায়, দাড়িতে ও সারা শরীরে মাখা যায়। ইহরাম পরিধানের পর যদি এর সুগন্ধ শরীরে থেকে যায় তাতে কোন অসুবিধা নেই। মনে রাখতে হবে, মেয়েরা সুগন্ধি লাগাবে না।
প্রঃ ৩৪- পুরুষের ইহরামের কাপড় কেমন হতে হবে?
উঃ- চাদরের মত দু'টুকরা কাপড় একটি নীচে পরবে। দ্বিতীয়টি গায়ে দিবে। কাপড়গুলো সেলাইবিহীন হতে হবে। পরিচ্ছন্ন ও সাদা রং হওয়া মুস্তাহাব। ৩য় আর কোন প্রকার কাপড় গায়ে রাখা যাবে না। যেমন টুপি, গেঞ্জি, জাইঙ্গা বা তাবীজ কিছুই না। তবে শীত নিবারণের জন্য চাদর ও কম্বল ব্যবহার করতে পারবে।
প্রঃ ৩৫। মেয়েদের ইহরামের কাপড় কী ধরনের হওয়া চাই?
উঃ- মেয়েদের ইহরামের জন্য বিশেষ কোন পোষাক নেই। মেয়েরা সাধারণত : যে কাপড় পরে থাকে সেটাই তাদের ইহরাম। তারা নিজ ইচ্ছা মোতাবেক ঢিলেঢালা ও শালীন পোষাক পরবে। তবে যেন পুরুষের পোষাকের মত না হয়। এটা কাল, সবুজ বা অন্য যে কোন রঙের হতে পারে।
প্রঃ৩৬-ইহরামের ওয়াজিব কয়টি ও কী কী?
উঃ-৩টি যথা :
(১) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা।
(২) সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করা।
(৩) তালবিয়াহ পাঠ করা। অর্থাৎ নিয়ত করার পর তালবিয়াহ পাঠ করা ওয়াজিব।
প্রঃ ৩৭- ইহরাম অবস্থায় মেয়েরা কি মুখ ঢেকে রাখতে (নিকাব পরতে) ও হাত মোজা (কুফ্‌ফাযাইন) পরতে পারবে?
উঃ- না। নিকাব ও হাতমোজা এ অবস্থায় পরবে না। তবে ভিন্ন পুরুষ সামনে এলে মুখ আড়াল করে রাখবে। অর্থাৎ নিকাব ছাড়া ওড়না বা অন্য কোন কাপড় দ্বারা মুখমণ্ডল ঢাকার অনুমতি আছে।
প্রঃ ৩৮- ইহরামের সময় হায়েয-নেফাসওয়ালী মেয়েরা কি করবে?
উঃ- তারা পরিচ্ছন্ন হবে, গোসল করবে, ইহরাম পরবে। কিন্তু হায়েয-নেফাস অবস্থায় নামায পড়বে না এবং কাবাঘর তাওয়াফ করবে না। বাকী অন্যসব কাজ করবে। এরপর যখন পবিত্র হবে তখন অজু-গোসল করে তাওয়াফ ও সাঈ করবে। যদি ইহরামের পর হায়েয শুরু হয় তখনো কাবা তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ পবিত্র না হয়।
প্রঃ ৩৯- ইহরাম অবস্থায় পায়ে কী পরবে?
উঃ- পায়ের গোড়ালী ঢেকে রাখে এমন কোন জুতা পরা যাবে না। কাপড়ের মোজাও পরবে না। তবে সেন্ডেল পরতে পারে।
প্রঃ ৪০- বাংলাদেশ থেকে গমনকারী লোকেরা যদি নিজ বাড়ী বা ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ইহরাম পরে তবে কি তা জায়েয?
উঃ হ্যাঁ, তা জায়েয আছে। ইহরামের কাপড় মীকাত থেকে পরা সুন্নাত হলেও বিমান বা যানবাহনে উঠার আগেই গোসল করে ইহরামের কাপড় পরে নিতে পারেন। তবে নিয়ত করা উচিত মীকাতে পৌঁছে বা এর পূর্বক্ষণে। কারণ, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাতে পৌছার আগে নিয়ত করতেন না। কাজেই মীকাতে পৌছার আগে নিয়তও করবে না এবং তালবিয়াহ পাঠও শুরু করবে না।
বিভিন্ন এয়ারলাইনসে ট্রানজিট পেসেন্‌জার হিসেবে যারা আবুধাবী, দুবাই, কুয়েত, দুহা, বাহরাইন, মাসকাট ও সানআ এয়ারপোর্টে নামবেন তারা সেখানেও পরিচ্ছন্নতা ও অজু-গোসলের কাজ সেরে ইহরামের কাপড় পরে নিতে পারেন। এরপর বিমানে যখন মীকাতে পৌঁছার ঘোষণা দেবে তখনই নিয়ত করে নেবেন এবং তালবিয়াহ পাঠ শুরু করবেন। তবে ঘোষণা দেয়ার সঙ্গেই নিয়ত করে ফেলবেন। কারণ বিমান খুবই দ্রুত চলে। আপনার নিয়ত করা যেন মীকাতে পৌঁছার আগেই হয়ে যায়। তা না হলে দম দিতে হবে।
প্রঃ ৪১- নিয়ত কীভাবে করতে হয়?
উঃ- নামাযসহ অন্যান্য সকল ইবাদাতের নিয়ত করতে হয় মনে ইচ্ছা পোষণ করে। তবে ইহরামের সময় মুখে শুধু হজ্জ বা উমরা শব্দ উচ্চারণ করতে হয়।
প্রঃ ৪২- উমরা ও হজ্জের ক্ষেত্রে কি শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করতে হয়?
উঃ- (ক) উমরার সময় বলবেন-
لَبَّيْكَ عُمْرَةً অথবা বলবেন, اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ عُمْرَةً
(খ) হজ্জের সময় :
لَبَّيْكَ حَجًّا অথবা বলবেন, اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ حَجًّا
(গ) উমরা ও হজ্জ একত্রে করলে
বলবেন- لَبَّيْكَ حَجًّا وَعُمْرَةً
(ঘ) বদলী হজ্জের সময় 'লাব্বইকা ...' পক্ষ থেকে। لَبَّيْكَ عَنْ (فلان)
যারা প্রথমে উমরা করবেন এবং ৮ই যিলহজ্জ তারিখে হজ্জ করবেন তারা মীকাত থেকে শুধুমাত্র উমরার নিয়ত করবেন। উমরা ও হজ্জের নিয়ত একত্রে করবেন না।
প্রঃ ৪৩- নিয়ত শেষ হওয়ামাত্র কোন কাজটি করতে হবে।
উঃ- তালবিয়াহ পাঠ শুরু করবেন, আর তা-
(ক) বেশী বেশী পড়বেন।
(খ) উচ্চস্বরে পড়বেন।
(গ) তবে মেয়েরা পড়বে নীচু স্বরে, যাতে সে কেবল নিজে শুনতে পায়।
(ঘ) বেশী বেশী যিক্‌র আয্‌কার করতে থাকবে।
(ঙ) কিবলামুখী হয়ে তালবিয়াহ পড়া উত্তম, তাছাড়া উচু থেকে নীচে নামা ও নিচু থেকে উঁচু স্থানে উঠার সময়ও তালবিয়াহ পাঠ করা সুন্নাত।
প্রঃ ৪৪- তালবিয়ার বাক্যটি কেমন?
উঃ- তালবিয়ার বাক্যটি নিম্নরূপ :
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ - لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ু إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ - لاَ شَرِيكَ لَكَ
অর্থ : হাজির হয়েছি হে আল্লাহ! তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হয়েছি। আমি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার কোন শরীক নাই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামাত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোন শরীক নেই।
لَبَّيْكَ = হাজির হয়েছি, اللَّهُمَّ = হে আল্লাহ, لاَ شَرِيكَ=কোন শরীক নাই, لَكَ=তোমার إِنَّ=নিশ্চয়, الْحَمْدَ=সকল প্রশংসা, النِّعْمَةَ=নেয়ামত, الْمُلْكَ=রাজত্ব।
প্রঃ ৪৫- তালবিয়াহ পাঠ কখন শুরু করব এবং কখন শেষ করব?
উঃ-ইহরামের কাপড় পরার পর যখনই নিয়ত করা শেষ করবেন তখন থেকে তালবিয়াহ পাঠ শুরু করবেন, আর শেষ করবেন হারাম শরীফে পৌঁছে তাওয়াফ শুরুর পূর্বক্ষণে। আর হজ্জের বেলায় ১০ই যিলহজ্জে বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকবেন।
প্রঃ ৪৬- কখনো কখনো কিছু লোককে দল বেঁধে সমস্বরে তালবিয়াহ পড়তে দেখা যায়। এর হুকুম কী?
উঃ- এটি ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এমনটি করেননি। উলামায়ে কিরাম এটিকে বিদআত বলেছেন। বিশুদ্ধ হলো একাকী নিজে নিজে তালবিয়াহ পাঠ করা।
প্রঃ ৪৭- তালবিয়াহ পড়লে কি সওয়াব হয়?
উঃ- হাদীসে আছে
(১) তালবিয়াহ পাঠকারীর সাথে তার ডান ও বামের গাছপালা এবং পাথরগুলোও তালবিয়াহ পড়তে থাকে।
(২) তালবিয়াহ পাঠকারীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়।
প্রঃ ৪৮- ইহরাম পরে যে দু'রাকাত নামায পড়া হয় তা কি উমরা বা হজ্জের নিয়তে? নাকি তাহিয়াতুল অজুর নিয়তে?
উঃ- ঐ দু'রাকাত নামায তাহিয়াতুল অজুর নিয়তে পড়বেন। আর ফরয নামায আদায়ের পর হলে স্বতন্ত্র আর কোন নামায পড়তে হবে না।
প্রঃ ৪৯- ইহরাম অবস্থায় কি কি কাজ নিষিদ্ধ?
উঃ- নিষিদ্ধ কাজগুলো নিম্নরূপ :
(১) চুল উঠানো বা কাটা, হাত ও পায়ের নখ কাটা। তবে শরীর চুলকানোর সময় ভুলে বা অজ্ঞাতসারে যদি কিছু চুল পড়ে যায় তাতে অসুবিধা নেই।
(২) ইহরাম বাঁধার পর সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না।
(৩) স্ত্রী সহবাস, যৌনক্রিয়া বা উত্তেজনার সাথে স্ত্রীর দিকে তাকানো, তাকে স্পর্শ করা, চুম্বন করা, মর্দন ও আলিঙ্গন করা বা এ জাতীয় কথা বলা নিষেধ।
(৪) বিবাহ করা বা দেয়া, এমনকি প্রস্তাব দেওয়াও নিষেধ। চাই নিজের বা অন্যের হোক, উভয়ই নিষেধ।
(৫) স্থলজ প্রাণী শিকার করা বা হত্যা করা নিষিদ্ধ। এতে সহযোগিতা করবেন না। কিন্তু পানির মাছ ধরতে পারবেন। হারামের সীমানার ভিতর প্রাণী শিকার করা ইহরাম বিহীন লোকদের জন্যও নিষেধ।
(৬) সেলাইযুক্ত কাপড় পরা, এটা করা যাবে না। তবে ঘড়ি, আংটি, চশমা, কানের শ্রবণ যন্ত্র, বেল্ট, মানিব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবেন।
(৭) মেয়েরা সেলাইযুক্ত কাপড় পরতে পারবে।
(৮) মাথা ঢেকে রাখা নিষেধ। মুখও ঢাকবে না। ইহরামের কাপড়, পাগড়ী, টুপি তোয়ালে, গামছা বা অন্য কোন কাপড় দিয়েও মাথা ঢেকে রাখা যাবে না। তবে ছাতা, তাবু, গাড়ীর বা ঘরের ছাদের ছায়ার নীচে বসতে পারবেন। ভুলে বা অজ্ঞাতসারে যদি মাথা ঢেকে ফেলে তবে স্মরণ হওয়া মাত্র তা সরিয়ে ফেলতে হবে। মেয়েরা মাথা ঢেকে রাখবে।
(৯) মহিলারা হাত মোজা পরবে না। নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকবে না। পর্দার প্রয়োজন হলে উড়না দিয়ে ঢাকবে।
(১০) ঝগড়া-ঝাটি করবে না।
(১১) ইহরাম অবস্থায় থাকুক বা না থাকুক মক্কা শরীফের হারামের সীমানার ভিতরে কেউ এমনিতেই গজিয়ে উঠা কোন গাছ বা সবুজ বৃক্ষলতা কাটতে পারবে না।
প্রঃ ৫০- ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষেধ এর কোন একটা কাজ যদি ভুলে বা না জেনে করে ফেলে তাহলে কী করতে হবে?
উঃ- এ জন্য কোন দম বা ফিদইয়া দিতে হবে না। স্মরণ হওয়া মাত্র বা অবগত হওয়ার সাথে সাথে এ কাজ থেকে বিরত হয়ে যাবে এবং এজন্য ইস্তেগফার করবে। তবে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
প্রঃ ৫১- কিন্তু উযর বশতঃ একান্ত বাধ্য হয়ে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মাথার চুল উঠায় বা কেটে ফেলে তাহলে কী করতে হবে?
উঃ- ফিদইয়া দিতে হবে। আর এর পরিমাণ হলোঃ
(ক) একটি ছাগল জবাই করে গোশত বিলিয়ে দেয়া, অথবা
(খ) لكل مسكين نصف صاعةছয়জন মিসকিনকে এক বেলা খানা খাওয়াতে হবে, (প্রত্যেককে এক কেজি বিশ গ্রাম পরিমাণ) অথবা
(গ) তিনদিন রোযা রাখবে।
উলামায়ে কিরামের কিয়াস অনুসারে মাথা ছাড়া অন্য অংশ থেকে চুল উঠালে বা কাটলে অথবা নখ কাটলে উপরে বর্ণিত ফিদইয়া কার্যকরী হবে।
প্রঃ ৫২- ইহরামরত অবস্থায় কি কি কাজ বৈধ?
উঃ- নিম্ন বর্ণিত কাজগুলো বৈধঃ
(১) গোসল করতে পারবে। পরনের ইহরামের কাপড় বদলিয়ে আরেক জোড়া ইহরাম পরতে পারবে, ময়লা হলে কাপড় ধৌত করা যাবে।
(২) ইহরাম অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো, ফোঁড়া গালানো, দাঁত উঠানো ও অপারেশন করা যাবে।
(৩) মোরগ, ছাগল, গরু, উট ইত্যাদি জবাই করতে পারবে এবং পানিতে মাছ ধরতে পারবে।
(৪) মানুষের জন্য ক্ষতিকারক প্রাণী যেমন : কুকুর, চিল, কাক, ইঁদুর, সাপ, বিচ্ছু, মশা, মাছি ও পিঁপড়া মারা যাবে। (নাসাঈ ২৮৩৫)
خَمْسٌ مِنْ الدَّوَابِّ لاَ جُنَاحَ فِي قَتْلِهِنَّ عَلَى مَنْ قَتَلَهُنَّ فِي الْحَرَمِ وَالإِحْرَامِ الْفَأْرَةُ وَالْحِدَأَةُ وَالْغُرَابُ وَالْعَقْرَبُ وَالْكَلْبُ الْعَقُورُ
পাঁচ ধরনের প্রাণীকে হারামে ইহরাম অবস্থায় হত্যা করলে হত্যাকারীর কোন গুনাহ হবে না। সেগুলো হল : ইদুর, চিল, কাক, বিচ্ছু ও হিংস্র কুকুর।
(৫) প্রয়োজন হলে আস্তে আস্তে শরীর চুলকানো যাবে।
(৬) বেল্ট, আংটি, ঘড়ি, চশমা পরতে পারবে।
(৭) যেকোন ছায়ার নীচে বসতে পারবে।
(৮) সুগন্ধযুক্ত না হলে সুরমা ব্যবহার করা যাবে।
(৯) মেয়েরা সেলাইযুক্ত কাপড় পরতে পারবে এবং অলংকারও ব্যবহার করতে পারবে।
(১০) ইহরাম অবস্থায় পুরুষেরাও ছোটখাট সেলাই কাজ করতে পারবে।
(১১) কোমরের বেল্টে টাকাপয়সা ও কাগজপত্র রাখতে পারবে।
(১২) ডাকাত বা ছিনতাইকারী দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে আক্রমণকারীকে হত্যাও করা যাবে। আর নিজে নিহত হলে শহীদ হবে। এ উদ্দেশ্যে অস্ত্রও বহন করা যাবে।
(১৩) ইহরাম অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে ইহরামের কোন ক্ষতি হয় না।
প্রঃ ৫৩- সুগন্ধিযুক্ত সাবান দিয়ে ইহরাম অবস্থায় হাত বা শরীর ধৌত করতে পারবে কি?
উঃ- না, সুগন্ধওয়ালা সাবান দিয়ে গোসল করা জায়েয নয়, এমনকি হাতও ধুইবে না।
প্রঃ ৫৪- কোন মুহরিম ব্যক্তি যদি অনুভব করে যে, তার থেকে প্রসাবের ফোটা বা মযী বের হয়েছে তখন কি করবে?
উঃ- তখন ইস্তিনজা করে ঐ অংশটি ধুয়ে পরিষ্কার করে নেবে। আর সালাতের ওয়াক্ত হলে অজু করে সালাত আদায় করবে।
প্রঃ ৫৫- ইহরাম পরা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে কি করতে হবে?
উঃ- এমনটি ঘটলে ফরয গোসল করে নেবে এবং কাপড় ধুয়ে ফেলবে। এতে হজ্জ বা উমরার কোন ক্ষতি হবে না। এমনকি ফিদইয়াও দিতে হবে না। কারণ স্বপ্নদোষ মানুষের ইচ্ছাধীন কোন ঘটনা নয়।
প্রঃ৫৬- অযু-গোসল বা চুলকানোর কারনে অনিচ্ছাকৃতভাবে মাথা, গোঁফ, দাড়ি বা শরীর থেকে কিছু চুল পড়ে গেলে কি হবে?
উঃ- এতে হজ্জ বা উমরার কোন ক্ষতি হবে না। এমনকি নখের অংশবিশেষ পড়ে গেলেও সমস্যা নেই।
প্রঃ ৫৭- হজ্জের সময় বা ইহরামরত অবস্থায় যদি কেউ স্ত্রী সহবাস করে তবে এর হুকুম কি?
উঃ- অধিকাংশ উলামাদের মতে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে স্বামী স্ত্রীর দু'জনেরই। সে সহবাস আরাফাতে অবস্থানের আগে হোক বা পরে হোক। আর হজ্জ বাতিল হয়ে গেলে পরবর্তী বছর এ হজ্জ কাযা করতে হবে।
প্রশ্নঃ ৫৮- ঠাণ্ডা লাগলে ইহরাম অবস্থায় গলায় মাফলার ব্যবহার করতে পারবে কি?
উঃ হ্যাঁ।
প্রঃ ৫৯- হারাম শরীফের সীমানা কতটুকু? মিনা ও মুযদালিফা হারামের ভিতরে না বাহিরে?
উঃ- এ দু'টো এলাকা হারামের সীমানার ভিতরে অবস্থিত। অর্থাৎ হারামের অংশ। কিন্তু আরাফাতের ময়দান হারামের বাহিরে। হারামের সীমানা কাবা ঘর থেকে :
(ক) পূর্ব দিকে ১৬ কিলোমিটার 'জিরানা' পর্যন্ত।
(খ) পশ্চিম দিকে 'হুদাইবিয়া (শুমাইছী)' পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার।
(গ) উত্তর দিকে ৬ কিলোমিটার 'তানঈম' পর্যন্ত।
(ঘ) দক্ষিণ দিকে ১২ কিলোমিটার 'আদাহ' পর্যন্ত।
(ঙ) উত্তর-পূর্ব কোণে ১৪ কিলোমিটার 'ওয়াদী নাখলা' পর্যন্ত।

৬ষ্ঠ অধ্যায়
মক্কায় প্রবেশ ও উমরা পালন

প্রঃ ৬০- মক্কায় প্রবেশের পর প্রথম কাজ উমরা করা, কিন্তু উমরা কিভাবে করতে হয়?
উঃ- মসজিদুল হারামে ঢুকে প্রথমে ৭ বার কাবাঘর তাওয়াফ করবেন। এরপর দু'রাকআত নামায শেষে 'সাফা' ও 'মারওয়া' পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ করবেন ৭ বার। সবশেষে চুল কেটে হালাল হয়ে যাবেন, অর্থাৎ ইহরামের কাপড় বদলিয়ে স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করবেন। তাওয়াফ, সাঈ ও চুল কাটার বিস্তারিত নিয়ম পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে দেখুন।

৭ম অধ্যায়
 الطواف
তাওয়াফ

প্রঃ ৬১- মক্কায় প্রবেশের আদব হিসেবে তাওয়াফের পূর্বে কি কি কাজ আমাদের করণীয় আছে?
উঃ- কাজগুলো নিম্নরূপ :
(১) মক্কায় পৌঁছে সুবিধাজনক কোন স্থানে একটু বিশ্রাম করা যাতে ক্লান্তি দূর হয় এবং শক্তি অর্জিত হয়। তাছাড়া তাওয়াফের পূর্বে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া জরুরী। (বুখারী)
(২) সম্ভব হলে গোসল করে নেয়া মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। (বুখারী) সুযোগ না পেলে না-করলেও চলবে। তবে নাপাকী থেকে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে।
(৩) সহজসাধ্য হলে উঁচুভূমি এলাকা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করাও মুস্তাহাব। (বুখারী) "বাবুস্‌ সালাম" গেট দিয়ে ঢুকা উত্তম। তা সম্ভব না হলে যে কোন দরজা দিয়ে ঢুকতে পারেন।
(৪) হারাম শরীফে প্রবেশকালে উত্তম হলো ডান পা আগে দিয়ে ঢুকা এবং নীচের দোয়াটি পড়াঃ
أَعُوذُ بِاللهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ بِسْمِ اللهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰى رَسُوْلِ اللهِ - اَللَّهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ
এবং মসজিদে হারাম থেকে বের হওয়ার সময় পড়াঃ
بِسْمِ اللهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰى رَسُوْلِ اللهِ اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
এ দোয়াগুলো দুনিয়ার অন্যসব মসজিদেও পড়া সুন্নত।
(৫) "মসজিদে হারাম"এর তাহিয়াহ হল তাওয়াফ করা। আর তাওয়াফের নিয়ত না থাকলে দু'রাকআত সালাত আদায় না করে মসজিদে কখনো বসবেন না। তবে, জামাআত দাঁড়িয়ে গেলে সরাসরি জামাআতে শরীক হয়ে যাবেন।
(৬) অসুস্থ ও মাযুর ব্যক্তিদের জন্য খাটিয়ায় চড়ে তাওয়াফ বা সাঈ করা জায়েয আছে। (বুখারী)
(৭) প্রথম তাওয়াফকে 'তাওয়াফুল কুদুম'
(طواف القدوم) বা 'তাওয়াফুল উমরা' বলে।
প্রঃ ৬২- তাওয়াফের শর্ত কয়টি ও কী কী?
উঃ- আমাদের হানাফী মাযহাব মতে তাওয়াফের শর্ত ৩টি, যথা :
(১) তাওয়াফের নিয়ত করা,
(২) তাওয়াফের ৭ চক্র পূর্ণ করা,
(৩) মসজিদে হারামের ভিতরে থেকে কাবার চারপাশে তাওয়াফ করা।
প্রঃ ৬৩- তাওয়াফের ওয়াজিব কয়টি ও কী কী?
উঃ- ৫টি, সেগুলো হলো :
(১) অযূ করা।
(২) সতর ঢাকা।
(৩) হাজ্‌রে আসওয়াদকে বামপাশে রেখে তাওয়াফ করা।
(৪) তাওয়াফের পর দু'রাকআত সালাত আদায় করা।
প্রঃ ৬৪- তাওয়াফ কী? এটা কিভাবে করতে হয়?
উঃ- তাওয়াফ হল কাবা ঘরের চারপাশে ৭ বার প্রদক্ষিণ করা। এ তাওয়াফ করার নিয়মাবলী নীচে উল্লেখ করা হলঃ
(১) তাওয়াফ শুরু করার পূর্বেই তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দেয়া। এরপর মনে মনে তাওয়াফের নিয়ত করা। নিয়ত না করলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। নিয়ম হল প্রথমে 'হাজারে আসওয়াদ (কাল পাথরের) কাছে যাওয়া, "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার" বলে এ পাথরকে চুমু দিয়ে তাওয়াফ কার্য শুরু করা। কিন্তু রমাযান ও হজ্জের মৌসুমে প্রচণ্ড ভীড় থাকে। বয়স্ক, বৃদ্ধ ও মহিলাদের জন্য পাথর চুম্বনের কাজটি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের ভীড় দেখলে ধাক্কাধাক্কি করে নিজেকে ও অন্য হাজীকে কষ্ট না দিয়ে পাথর চুমু দেয়া ছাড়াই "হাজ্‌রে আসওয়াদ" থেকে তাওয়াফ শুরু করে দিবেন। কাবাঘরের "হাজারে আসওয়াদ" কোণ থেকে মসজিদে হারামের দেয়াল ঘেষে সবুজ বাতি দেয়া আছে। এ রেখা বরাবর থেকে তাওয়াফ শুরু করে আবার এখানে আসলে তাওয়াফের এক চক্র শেষ হবে। এভাবে ৭ চক্র পূর্ণ করতে হবে। ভীড়ের পরিমাণ যদি আরো বেশী দেখতে পান এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাওয়াফ করা কঠিন মনে করেন তাহলে দু'তলা বা ছাদের উপর দিয়েও তাওয়াফ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সময় একটু বেশী লাগলেও ভীড়ের চাপ থেকে রেহাই পাবেন। ছাদের উপর তাওয়াফ করলে দিনের প্রখর রৌদ্রতাপ ও প্রচণ্ড গরমে না গিয়ে রাতের বেলায় করবেন। বেশী ভীড়ের মধ্যে ঢুকে মানুষকে কষ্ট দেবেন না। দিলে ইবাদত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
(২) কাবাঘরকে বামপাশে রেখে তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফের প্রথম চক্রে "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার" বলে নীচের দোয়াটি পড়তে পারলে ভাল হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। দোয়াটি হল :
اَللَّهُمَّ إِيْمَانًا بِكَ وَتَصْدِيْقًا بِكِتَابِكَ وَوَفَاءً بِعَهْدِكَ وَاتِّبَاعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ مَحَمَّدٍ -صلى الله عليه وسلم-
অর্থ : হে আল্লাহ! তোমার প্রতি ঈমান এনে, তোমার কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের জন্য তোমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করে এ তাওয়াফ কার্যটি করছি।
(৩) প্রথম তিন চক্রে পুরুষগণ ছোট ছোট পদক্ষেপে দৌড়ের ভঙ্গিতে সামান্য একটু দ্রুত গতিতে চলতে চেষ্টা করবেন। আরবীতে এটাকে 'রম্‌ল' বলা হয়। বাকী চার চক্র সাধারণ হাঁটার গতিতে চলবেন। মক্কায় প্রবেশ করে প্রথম যে তাওয়াফটি করতে হয় শুধু এটাতেই প্রথম তিন চক্রের রম্‌লের এ বিধান। এরপর যতবার তাওয়াফ করবেন সেগুলোতে আর "রম্‌ল" করতে হবে না। মহিলাদের রম্‌ল করতে হয় না।
(৪) পুরুষেরা ইহরামের গায়ের কাপড়টির একমাথা ডান বগলের নীচ দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে দেবেন যাতে ডান কাঁধ, বাহু ও হাত খোলা থাকে। কাপড়ের বাকী অংশ ও উভয় মাথা দিয়ে বাম কাঁধ ও বাহু ঢেকে ফেলবেন। এ নিয়মটাকে আরবীতেও اضطباع (ইয্‌তিবা) বলা হয়। এটা শুধুমাত্র প্রথম তাওয়াফে করতে হয়। পরবর্তী তাওয়াফগুলোতে এ নিয়ম নেই, অর্থাৎ ডান কাঁধ ও বাহু খোলা রাখতে হয় না।
(৫) কাবাঘরের চারটি কোণের মধ্যে একটি কোণের নাম হল "রুক্‌নে ইয়ামানী"। হাজ্‌রে আসওয়াদ-এর কোণটিকে প্রথম কোণ ধরে তাওয়াফ শুরু করে আসলে "রুক্‌নে ইয়ামানী" হবে চতুর্থ কোণ। এ "রুক্‌নে ইয়ামানী"র পাশে এসে পৌঁছলে ভীড় না হলে এ কোণকে ডান হাত দিয়ে ছুইতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু সাবধান, এ রুক্‌নে ইয়ামেনীকে চুমু দেবেন না, এর পাশে এসে হাত উঠিয়ে ইশারাও করবেন না এবং সেখানে 'আল্লাহু আকবার'ও বলবেন না। 'আল্লাহু আকবার' বলবেন হাজ্‌রে আসওয়াদে পৌঁছে। তাওয়াফ শুরু করবেন "হাজ্‌রে আওয়াদ" থেকে এবং শেষও করবেন সেখানে গিয়েই।
(৬) রুক্‌নে ইয়ামেনী ও হাজ্‌রে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে নিম্নের এ দোয়াটি পড়া মুস্তাহাব :
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থ : হে আমাদের রব! আমাদেরকে তুমি দুনিয়ায় সুখ দাও, আখেরাতেও আমাদেরকে সুখী কর এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও।[৪]
(৭) তাওয়াফের প্রত্যেক চক্রেই হাজ্‌রে আসওয়াদ ছুঁয়া ও চুমু দেয়া উত্তম। কিন্তু প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে এটি খুবই দূরূহ কাজ। সেক্ষেত্রে প্রতি চক্রেই হাজ্‌রে আসওয়াদের পাশে এসে এর দিকে মুখ করে ডান হাত উঠিয়ে ইশারা করবেন। ইশারাকৃত এ হাত চুম্বন করবেন না। ইশারা করার সময় একবার বলবেন بسم الله الله أكبر 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার'।
(৮) তাওয়াফরত অবস্থায় খুব বেশী বেশী যিক্‌র, দোয়া ও তাওবা করতে থাকবেন। কুরআন তিলাওয়াতও করা যায়। কিছু কিছু বইতে আছে প্রথম চক্রের দোয়া, ২য় চক্রের দোয়া ইত্যাদি। কুরআন হাদীসে এ ধরনের চক্রভিত্তিক দোয়ার কোন ভিত্তি নেই। যত পারেন একের পর এক দোয়া আপনি করতে থাকবেন। এ বইয়ের ২১ ও ২২ নং অধ্যায়ে কিছু দোয়া দেয়া আছে। এ দোয়াগুলো করতে পারেন। তাছাড়া আপনার নিজ ভাষায় আপনার মনের কথাগুলো আল্লাহ্‌র কাছে বলতে থাকবেন, মিনতি সহকারে চাইতে থাকবেন। দলবেঁধে সমস্বরে জোরে জোরে দোয়া করে অন্যদের দোয়ার মনোযোগ নষ্ট করবেন না। আরবীতে দোয়া করলে এগুলোর অর্থ জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন যাতে আল্লাহর সাথে আপনি কি বলছেন তা যেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন।
(৯) তাওয়াফের ৭ চক্র শেষ হলে দু'কাঁধ এবং বাহু ইহরামের কাপড় দিয়ে আবার ঢেকে ফেলবেন এবং "মাকামে ইব্‌রাহীমের" কাছে গিয়ে পড়বেন :
وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلّىً
অর্থ : ইব্‌রাহীম (পয়গাম্বর)-এর দণ্ডায়মানস্থলকে সালাত আদায়ের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো।[৫]
অতঃপর তাওয়াফ শেষে এ মাকামে ইব্‌রাহীমের পেছনে এসে দু'রাকআত সালাত আদায় করবেন। ভীড়ের কারণে এখানে জায়গা না পেলে মসজিদে হারামের যে কোন অংশে এ সালাত আদায় করা জায়েয আছে। মানুষকে কষ্ট দেবেন না, যে পথে মুসল্লীরা চলাফেরা করে সেখানে সালাতে দাঁড়াবেন না। সুন্নত হলো এ সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর প্রথম রাকআতে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া।
(১০) এরপর যমযমের পানি পান করতে যাওয়া মুস্তাহাব। পান শেষে যমযমের কিছু পানি মাথার উপর ঢেলে দেয়া সুন্নাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। (আহমাদ)
(১১) মুস্তাহাব হলো পুনরায় হাজ্‌রে আসওয়াদের কাছে গিয়ে এটা স্পর্শ করা ও চুম্বন করা। সম্ভব হলে এটা করবেন। আর ভীড় বেশী থাকলে এ কাজটা করতে যাবেন না।
(১২) বেগানা পুরুষের সামনে মহিলারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বনের সময় মুখ খোলা রাখবেন না। কাবার গা ঘেঁষে পুরুষদের মধ্যে না ঢুকে মেয়েদের একটু দূর দিয়ে তাওয়াফ করা উত্তম।
(১৩) তাওয়াফ করার সময় যদি জামা'আতের ইকামত দিয়ে দেয় তখন সঙ্গে সঙ্গে তাওয়াফ বন্ধ করে দিয়ে নামাযের জামা'আতে শরীক হবেন এবং ডান কাঁধ ও বাহু চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলবেন। নামায রত অবস্থায় কাঁধ ও বাহু খোলা রাখা জায়েয না। সালাত শেষে তাওয়াফের বাকী অংশ পূর্ণ করবেন।
প্রঃ ৬৫- প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে কোন পর মহিলার গা স্পর্শ হলে এতে তাওয়াফের কোন ক্ষতি হবে কি?
উঃ- না, অযুও ছুটবে না। তবে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রঃ ৬৬- তাওয়াফরত অবস্থায় শরীরের কোন স্থান ক্ষত হয়ে গেলে বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়লে এতে তাওয়াফের কোন ক্ষতি হবে কি?
উঃ- না।
প্রঃ ৬৭- বিশেষ করে মসজিদে হারামে মুসল্লীর সামনে দিয়ে কেউ হাঁটলে তার গোনাহ হবে কি?
উঃ- না। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ), তবে মুহাদ্দিস আলবানী (রহ.)-এর মতে হাঁটা জায়েয নয়। সেজন্য সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
প্রঃ ৬৮- তাওয়াফ শেষে দু'রাক'আত সালাত দিন ও রাতের যে কোন সময় এমনকি নিষিদ্ধ ও মাকরূহ ওয়াক্তেও আদায় করা যাবে কি?
উঃ- হ্যাঁ। তবে নিষিদ্ধ ৩টি সময়ে নামায না পড়া উত্তম।
প্রঃ ৬৯- তাওয়াফের দু'রাক'আত সালাত শেষে হাত তুলে দোয়া করার কোন বিধান শরীয়তে পাওয়া যায় কি?
উঃ- না, বরং এটা সুন্নাতের খেলাফ।
প্রঃ ৭০- তাওয়াফ শেষে কী কী কাজ সুন্নত?
উঃ- এখানে সুন্নাত হল যমযম পান করতে চলে যাওয়া, কিছু পানি মাথায় ঢেলে দেয়া, অতঃপর সম্ভব হলে পুনরায় হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করা। এরপর সাফা-মারওয়ায় সাঈ করতে চলে যাওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই করেছেন।
প্রঃ ৭১- রুকনে ইয়ামানী কি চুম্বন করা যাবে?
উঃ- না, এটা কখনো চুম্বন করবেন না। তবে "রুক্‌নে ইয়ামানী" স্পর্শ করা মুস্তাহাব।
প্রঃ ৭২- তাওয়াফের ৭ চক্রের মধ্যে এক চক্র কম হলে তাওয়াফ কি শুদ্ধ হবে?
উঃ- না।
প্রঃ ৭৩- তাওয়াফ পরবর্তী দু'রাক'আত সালাত কি তাওয়াফের অংশ?
উঃ- না। এটা পৃথক ইবাদত।
প্রঃ ৭৪- বহিরাগত লোকদের জন্য হারামে কোনটিতে সাওয়াব বেশী? নফল নামায নাকি নফল তাওয়াফ?
উঃ- তাওয়াফ। কারণ তাওয়াফের সুযোগ এখানে ছাড়া দুনিয়ায় আর কোথাও নেই।
প্রঃ ৭৫- নামাযীদের সামনে দিয়ে তাওয়াফরত পুরুষ-মহিলারা হাঁটলে কি তাতে মাকরূহ হবে?
উঃ- না। এ বিধান মক্কার জন্য খাস।
প্রঃ ৭৬- যে তিন ওয়াক্তে সালাত আদায় নিষিদ্ধ সে সময়ে তাওয়াফ করা কি জায়েয?।
উঃ- হাঁ। জায়েয।
প্রঃ ৭৭- হায়েয বা নেফাসওয়ালী মহিলারা পবিত্র হওয়ার আগে তাওয়াফ করতে পারবে কি?
উঃ- না।
প্রঃ ৭৮- যদি তাওয়াফ শেষ করার পর সাঈ শুরু করার পূর্বে কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়ে যায় তাহলে কী করবে?
উঃ- সাঈ করে ফেলবে। কারণ সাঈতে পবিত্রতা অর্জন শর্ত নয়, বরং মুস্তাহাব।
প্রঃ ৭৯- তাওয়াফুল কুদুম বা উমরার তাওয়াফ ছাড়া বাকী সব তাওয়াফ কী পোষাকে করব?
উঃ- স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করেই করবেন।
প্রঃ ৮০- "হাজারে আসওয়াদ" ও 'রুক্‌নে ইয়ামেনী" স্পর্শ করার ফযীলত জানতে চাই?
উঃ- এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
(ক) "হাজ্‌রে আসওয়াদ" ও "রুক্‌নে ইয়ামেনী"র স্পর্শ গুনাহগুলোকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলে দেয়। (তিরমিযী)
(খ) নিশ্চয় আল্লাহ তা'আলা "হাজ্‌রে আসওয়াদ"কে কিয়ামতের দিন উত্থিত করবেন। তার দু'টি চক্ষু থাকবে যা দ্বারা সে দেখতে পাবে, একটি জিহ্বা থাকবে যা দ্বারা সে কথা বলবে এবং যারা তাকে স্পর্শ করেছে সত্যিকারভাবে এ পাথর তাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে। (তিরমিযী)
প্রঃ ৮১- তাওয়াফে হাজীদের সাধারণত কী কী ভুলত্রুটি লক্ষ্য করা যায়?
উঃ- (ক) হাজারে আসওয়াদের কাছে এসে দু'হাতে ইশারা দেয়। এটা ভুল। শুদ্ধ হলো এক হাতে দেয়া।
(খ) রুক্‌নে ইয়ামানী হাত দিয়ে ইশারা করে। এটা করা ঠিক নয়।
(গ) কিছু লোক তাওয়াফের সময় কাবার চার কোণই স্পর্শ করে। এরূপ করতে যাওয়া ঠিক না।
(ঘ) তাওয়াফের সময় কেউ কেউ কাবাঘর বা এর গেলাফ মুছে। এ মুছার মধ্যে কোন ফযীলত নেই।
(ঙ) কিছু লোক তাওয়াফের সময় দল বেঁধে যিক্‌র ও দোয়া করে। এটা করবেন না।
(চ) এক শ্রেণীর লোক বেরিকেড দিয়ে দল বেঁধে তাওয়াফ করে। অন্যদেরকে কষ্ট দিয়ে এভাবে তাওয়াফ করা উচিত না।
(ছ) কেউ কেউ মাকামে ইব্‌রাহীম চুমু দেয় এবং এটাতে হাত দিয়ে মুছে। এসব ভুল কাজ।
৮ম অধ্যায়
 السعي
সাঈ করা

প্রঃ ৮২- সাঈ কি?
উঃ- সাঈ অর্থ দৌড়ানো। কাবার অতি নিকটেই দু'টো ছোট্ট পাহাড় আছে যার একটি 'সাফা' ও অপরটির নাম 'মারওয়া'। এ দু' পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে মা হাজেরা শিশুপুত্র ইসমাঈল ঁ-এর পানির জন্য ছোটাছুটি করেছিলেন। ঠিক এ জায়গাতেই হজ্জ ও উমরা পালনকারীদেরকে দৌড়াতে হয়। শাব্দিক অর্থে দৌড়ানো হলেও পারিভাষিক অর্থে স্বাভাবিক গতিতে চলা। শুধুমাত্র দুই সবুজ পিলার দ্বারা চিহ্নিত মধ্যবর্তী স্থানে সামান্য একটু দৌড়ের গতিতে চলতে হয়। তবে মেয়েরা দৌড়াবে না।
প্রঃ ৮৩- সাঈর হুকুম কী?
উঃ- সাঈর কাজটি ওয়াজিব। তবে কেউ কেউ এটা রুক্‌ন অর্থাৎ ফরয বলেছেন।
প্রশ্ন-৮৪ : সাঈর শর্ত ও ওয়াজিবসমূহ কি কি?
উঃ- (১) প্রথমে তাওয়াফ এবং পরে সাঈ করা।
(২) 'সাফা' থেকে শুরু করা এবং 'মারওয়া'য় গিয়ে শেষ করা।
(৩) 'সাফা' ও 'মারওয়া'র মধ্যবর্তী পূর্ণ দূরত্ব অতিক্রম করা। একটু কম হলে চলবে না।
(৪) সাত চক্র পূর্ণ করা।
(৫) সাঈ করার স্থানেই সাঈ করতে হবে। এর পাশ দিয়ে করলে চলবে না।
প্রশ্ন-৮৫ : সাঈর সুন্নাত কী কী?
উঃ- (ক) অযু অবস্থায় সাঈ করা ও সতর ঢাকা।
(খ) তাওয়াফ শেষে লম্বা সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গে সাঈ শুরু করা।
(গ) সাঈর এক চক্র শেষ হলে লম্বা সময় না থেমে পরবর্তী চক্র শুরু করা।
(ঘ) দু'টি সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষদের একটু দৌড়ানো।
(ঙ) প্রতি চক্রেই সাফা ও মারওয়া পাহাড় দু'টিতে আরোহণ করা।
(চ) সাফা ও মারওয়া পাহাড় এবং এর মধ্যবর্তী স্থানে যিক্‌র ও দোয়া করা।
(ছ) সক্ষম ব্যক্তির পায়ে হেঁটে সাঈ করা।
প্রঃ ৮৬- সাঈ কিভাবে শুরু ও শেষ করব তা ধারাবাহিকভাবে জানতে চাই?
উঃ- (১) তাওয়াফ শেষ করেই 'সাফা' পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দেবেন। সাফাতে উঠার সময় নীচের দোয়াটি পড়বেন :
إن الصفا والمروة من شعائر الله (أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللهُ بِه)
অর্থ : "অবশ্যই 'সাফা' এবং 'মারওয়া' হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম।" আল্লাহ যেভাবে শুরু করেছেন আমিও সেভাবে শুরু করছি।
এ দোয়াটি এখানে ছাড়া আর কোথাও পড়বেন না। সাঈর প্রথম চক্রের শুরুতেই শুধুমাত্র পড়বেন। প্রতি চক্রে বারবার এটা পুনরাবৃত্তি করবেন না।
(২) এরপর যতটুকু সম্ভব সাফা পাহাড়ে উঠুন। একেবারে চূড়ায় আরোহণ করা জরুরী নয়। তারপর কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে হাত তুলে নীচের দোয়াটি পড়ুন :
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ ু لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهচ্ لاَ شَرِيكَ لَهচ্ ু لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ু لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهচ্ لاَ شَرِيكَ لَـه، ু أَنْجَزَ وَعْدَه، ু وَنَصَرَ عَبْدَه، ু وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَه.
অর্থ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও একক, তাঁর কোন শরীক নেই। আসমান যমীনের সার্বভৌম আধিপত্য একমাত্র তাঁরই। সকল প্রশংসা শুধু তাঁরই প্রাপ্য। তিনিই প্রাণ দেন এবং তিনিই আবার মৃত্যুবরণ করান। সবকিছুর উপরই তিনি অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। যত ওয়াদা তাঁর আছে তা সবই তিনি পূরণ করেছেন। স্বীয় বান্দাকে তিনি সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুদলকে পরাস্ত করেছেন। (আবূ দাউদ : ১৯০৫)
এ দোয়াটি তিনবার পড়ার পর দু'হাত উঠিয়ে যত পারেন দোয়া করুন, আরবীতে বা নিজের ভাষায় দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্য কল্যাণ চাইতে থাকুন।
(৩) অতঃপর 'সাফা' থেকে নেমে 'মারওয়া'র দিকে হাঁটতে থাকুন। আর আল্লাহ্‌র যিক্‌র ও দোয়া করতে থাকুন নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য এবং মুসলিম মিল্লাতের সবার জন্য। যখন সবুজ চিহ্নিত স্থানে পৌঁছবেন সেখান থেকে পরবর্তী সবুজ চিহ্নিত স্থান পর্যন্ত পুরুষেরা যথাসাধ্য দৌড়াতে চেষ্টা করবেন। তবে কাউকে কষ্ট দেবেন না। দ্বিতীয় সবুজ চিহ্নিত স্থানটি অতিক্রম করার পর আবার সাধারণভাবে হাঁটা শুরু করবেন। এভাবে হেঁটে মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে এর উঁচুতে আরোহণ করবেন। অতঃপর কিবলামুখী হয়ে 'সাফা' পাহাড়ে যা যা করেছিলেন সেগুলো এখানেও করবেন। অর্থাৎ الله أكبر থেকে শুরু করে وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ পর্যন্ত পুরাটা পড়া তিনবার পড়া, অতঃপর দো'আ করা। 'সাফা' থেকে 'মারওয়া'য় আসার পর আপনার এক চক্র শেষ হল।
(৪) এবার আপনি 'মারওয়া' থেকে নেমে আবার 'সাফা'র দিকে চলতে থাকুন। সবুজ চিহ্নিত দুই বাতির মধ্যবর্তী স্থানে সাধ্যমত আবার দৌড়াতে থাকুন। যখনি সবুজ চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করে ফেলবেন তখনি আবার সাধারণ গতিতে হাঁটতে থাকবেন। 'সাফা' পাহাড়ে পৌঁছে প্রথমবার যা যা পড়েছিলেন ও করেছিলেন এবারও তা এখানে পড়বেন ও করবেন। আবার মারওয়ায় গিয়েও তাই করবেন। এভাবে প্রত্যেক চক্রেই এ নিয়ম পালন করে যাবেন। সাফা থেকে মারওয়ায় গেলে হয় এক চক্র, আবার মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে এলে হয় আরেক চক্র। এভাবে ৭ চক্র পূর্ণ করবেন।
(৫) 'মারওয়া'য় গিয়ে যখন ৭ চক্র পূর্ণ হবে তখন চুল কেটে আপনি হালাল হয়ে যাবেন। পুরুষেরা মাথা মুণ্ডন করবে অথবা সমগ্র মাথা থেকে চুল কেটে ছোট করে নেবে। আর মহিলারা আঙ্গুলের উপরের গিরার সমপরিমাণ চুল কাটবে। চুল কাটার আরো বিস্তারিত নিয়ম দেখুন পরবর্তী অধ্যায়ে। চুল কাটা শেষে আপনি হালাল হয়ে গেলেন। ইহরামের কাপড় খুলে অন্য কাপড় পরবেন। ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ আপনার জন্য নিষিদ্ধ ছিল এগুলো এখন বৈধ হয়ে গেল।
প্রঃ ৮৭- আমি পায়ে হেঁটে সাঈ শুরু করেছি। এরপর আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সেক্ষেত্রে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাকী চক্রগুলো ট্রলিতে করে পূর্ণ করতে পারব কি?
উঃ- হাঁ। পারবেন।
প্রঃ ৮৮- আমি সাঈ করে যাচ্ছি এমন সময় সালাতের ইকামাত দিয়ে দিলে আমি কি করব?
উঃ- সঙ্গে সঙ্গে জামা'আতে শরীক হয়ে যাবেন। সালাত শেষে বাকী চক্র পূর্ণ করবেন।
প্রঃ ৮৯- পবিত্র অবস্থায় সাঈ করা মুস্তাহাব। কিন্তু মাঝখানে যদি অযু ছুটে যায়?
উঃ- তখন সাঈ বন্ধ না করে বাকী চক্র পূর্ণ করবেন। সাঈ শুদ্ধ হবে। এমনকি তাওয়াফ শেষ করার পরও যদি কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়ে যায় তাহলে এ অবস্থায়ও সাঈ করে ফেলবে। এটা জায়েয আছে। কারণ সাঈর জন্য পবিত্রতা মুস্‌তাহাব, কিন্তু শর্ত নয়।
প্রঃ ৯০- সবুজ চিহ্নিত দুই দাগের মধ্যবর্তী স্থানে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন দু'আ আছে কি?
উঃ- হ্যাঁ, আছে। সে দু'আটি হল :
رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ إِنَّكَ أَنْتَ الأَعَزُّ الأَكْرَمُ
প্রঃ ৯১- ইফরাদ হজ্জে সাঈ কি হজ্জের পূর্বে করা যায়?
উঃ হ্যাঁ, করা যায়। তবে না করাই উত্তম।

৯ম অধ্যায়
اَلْحَلْقُ أَوِ التَّقْصِيْرُ
চুলকাটা 

প্রঃ ৯২- চুল কাটার হুকুম কী?
উঃ- চুলকাটা হজ্জ ও উমরা উভয় ইবাদতের ক্ষেত্রে ওয়াজিব।
প্রঃ ৯৩- পুরুষদের চুল কাটার নিয়ম ও ফযীলত জানতে চাই।
উঃ- (১) পুরা মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা মাথার সব অংশ থেকে চুল ছোট করে কেটে ফেলবেন।
(২) চুল ছোট করে কাটার চেয়ে মাথা মুণ্ডন করার মধ্যে সাওয়াব বেশী। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন (رحم الله المحلقين)। অপরদিকে যারা চুল খাট করে কেটেছেন তাদের জন্য মাত্র একবার উক্ত দোয়া করেছেন (.... المقصرين)।
(৩) মাথার কিছু অংশের চুল ছোট করে কাটলে যথেষ্ট হবে না, বরং সমগ্র মাথা থেকে চুল ছোট করে কাটা অত্যাবশ্যক।
মেয়েদের মাথা মুণ্ডনের বিধান নেই। তারা শুধু চুল ছোট করবে।
প্রঃ ৯৪- মহিলাদের চুল কি পরিমাণ কাটতে হবে?
উঃ- মহিলাদের জন্য মাথা মুণ্ডনের কোন বিধান নেই। তারা তাদের মাথার চার ভাগের একাংশ চুলের অগ্রভাগ থেকে আঙ্গুলের উপরের গিরার সমপরিমাণ (অর্থাৎ এক ইঞ্চির একটু কম) চুল কেটে দেবে। মেয়েরা এর চেয়ে বেশী পরিমাণ চুল কাটবে না।
لَيْسَ عَلَى النِّسَاءِ حَلْقٌ إِنَّمَا عَلَى النِّسَاءِ التَّقْصِيرُ
প্রঃ ৯৫- যাদের মাথায় টাক অর্থাৎ চুল নেই তাদের চুল কাটার নিয়ম কি?
উঃ- ব্লেড বা ক্ষুর দিয়ে সম্পূর্ণ মাথা কামিয়ে দিবে। চুলবিহীন মাথাও ব্লেড দিয়ে এভাবে মুণ্ডন করা হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব মতে ওয়াজিব।
প্রঃ ৯৬- উমরাহ শেষে ভুলে বা না জেনে চুল কাটার আগেই যদি ইহরামের কাপড় বদলিয়ে সাধারণ পোষাক পরিধান করে ফেলে তাহলে এর হুকুম কি?
উঃ- মনে হওয়া মাত্র সাধারণ পোষাক খুলে ফেলবে এবং পুনরায় ইহরামের কাপড় পরিধান করে মাথা মুণ্ডন বা চুল কেটে ফেলবে। এরপর সাধারণ পোষাক পরবে।
প্রঃ ৯৭- চুল কোন জায়গায় বসে কাটবে?
উঃ- যে কোন জায়গায় কাটতে পারেন। তবে উত্তম হলো উমরা পালনকারী 'মারওয়া'র আশেপাশে এবং হাজী মিনায় চুল কাটবে।
প্রঃ ৯৮- উমরা পালন শেষে হজ্জের সময় যদি খুব কম থাকে তাহলে কোন ধরনের চুল কাটলে ভাল হয়?
উঃ- পুরুষেরা উমরা শেষে চুল খাট করবে এবং হজ্জ শেষে মাথা মুণ্ডন করবে, এটাই উত্তম।
মীকাত থেকে ইহরাম বেঁধে তাওয়াফ, সাঈ ও চুলকাটা শেষ হলে আপনার উমরাহ পালন সম্পন্ন হয়ে গেল। এখন ইহরামের কাপড় বদলিয়ে স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করুন। অতঃপর হজ্জের ইচ্ছা থাকলে আপনি সে জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।

১০ম অধ্যায়
৮ই যিলহজ্জ তারিখের কাজ
(তারভিয়ার দিন يوم تروية)

প্রঃ ৯৯- আজকের দিনের কাজ কী কী?
উঃ- ইহরাম বেঁধে মিনায় রওয়ানা হওয়া এবং সেখানেই রাত্রি যাপন করা।
প্রঃ ১০০- হজ্জের ইহরাম বাঁধার আগে আমাদের করণীয় কাজ কী কী ?
উঃ- গোসল করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া ও গায়ে সুগন্ধি মাখা। তবে কুরবানীকারীরা ১লা যিলহজ্জ থেকে কুরবানীর পূর্ব পর্যন্ত চুল-নখ কাটবেন না।
প্রঃ ১০১- হজ্জের ইহরাম কোথা থেকে বাঁধতে হয়?
উঃ- নিজ নিজ ঘর বা বাসস্থান থেকেই ইহরাম বাঁধবেন। মক্কায় অবস্থানকারীরাও নিজ নিজ ঘর থেকে ইহরাম বাঁধবেন। ইফরাদ ও কেরান হাজীগণ যারা আগে থেকেই ইহরাম পরা অবস্থায় আছেন, তাঁরা ইহরাম অবস্থায়ই থাকবেন। ইহরামের পোষাক পরার পর হজ্জের নিয়ত করে ফেলবেন।
প্রঃ ১০২- কিভাবে হজ্জের নিয়ত করব? নিয়তের পর কি পড়তে হবে?
উঃ- হজ্জের জন্য মনে মনে নিয়ত করবেন এবং মুখেও বলবেন لَبَّيْكَ حَجًّا অথবা বলবেন اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ حَجًّا শেষ হলে তালবিয়াহ পড়তে থাকবেন। তালবিয়াহ হল :
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ু لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ুإِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ ু لاَ شَرِيكَ لَكَ
অতঃপর দলে দলে মিনার উদ্দেশ্যে চলতে থাকবেন গাড়ীতে হোক বা পায়ে হেঁটে হোক।
প্রঃ ১০৩- কখন মিনায় রওয়ানা দেব?
উঃ- সূর্যোদয়ের পর থেকে যুহরের নামাযের আগেই রওয়ানা দেয়া মুস্তাহাব। অর্থাৎ যুহরের নামাযের আগেই মিনায় চলে যাওয়া উত্তম।
প্রঃ ১০৪- মিনাতে সালাতগুলো কিভাবে আদায় করতে হবে?
উঃ- চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাযগুলো দু'রাকআত করে পড়তে হবে। এটাকে কসর করা বলা হয়। সে নামাযগুলো হলো যুহর, আসর ও এশা। হজ্জের সময় মিনা, আরাফা ও মুয্‌দালিফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ভিতরের ও বাইরের সকল লোককে নিয়ে এ সালাতগুলো কসর করে পড়েছিলেন, এটা সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে তিনি মুকীম বা মুসাফিরের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। অর্থাৎ মক্কার লোকদেরকেও চার রাকআত করে পড়তে বলেননি। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ও ফাতাওয়া ইবনে বায) তবে মনে রাখতে হবে যে, ফজর ও মাগরিবের ফরয নামায অর্থাৎ দুই এবং তিন রাকআত বিশিষ্ট নামায কখনো কসর হয় না। মিনাতে প্রত্যেক সালাত ওয়াক্তমত আদায় করবেন, জমা করবেন না। অর্থাৎ যুহর-আসর একত্রে এবং মাগরিব-এশা একত্রে পড়বেন না। এমনকি মুসাফির হলেও না।
প্রঃ ১০৫- আজকের দিনের মিনায় রাত্রিযাপনের হুকুম কি? মিনায় অবস্থান কতক্ষণ পর্যন্ত?
উঃ- মিনায় আজকের রাত্রি যাপন মুস্তাহাব বা সুন্নাত। যেহেতু আগামীকাল আরাফার দিন, সেহেতু আজকের রাতকে বলা হয় "আরাফার রাত"। এ রাতে সূর্য উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত মিনাতেই অবস্থান করা সুন্নাত।
প্রঃ ১০৬- যদি কেউ অযু-গোসল ছাড়াই ইহরাম বেঁধে ফেলে তবে তার হুকুম কি?
উঃ- ইহরাম জায়েয হবে। তবে সুন্নাত আমলের সাওয়াব পাবে না।
প্রঃ ১০৭- ৮ই যিলহজ্জ অর্থাৎ তারভিয়ার দিন হাজীরা সাধারণত কি ধরনের ভুল করে থাকে?
উঃ- (১) ৮ই যিলহজ্জ তারিখে ইহরাম বেঁধে তাওয়াফ ও সাঈ করে মিনায় রওয়ানা দেয় এবং দশ তারিখে তাওয়াফ করে আর সাঈ করে না। এটা ভুল। শুদ্ধ হলো ইহরাম বাঁধার পর তাওয়াফ ছাড়া মিনায় রওয়ানা দেবেন।
(২) কেউ কেউ সূর্যোদয়ের আগে মিনায় রওয়ানা দেয়। এটাও ভুল।

১১শ অধ্যায়
الوقوف بعرفة 
আরাফার মাঠে অবস্থান

প্রঃ ১০৮-আরাফার মাঠে অবস্থানের হুকুম কি?
উঃ- এটা হজ্জের রুকন। এটা বাতিল হয়ে গেলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
প্রঃ ১০৯- আজ কখন আরাফাতে রওয়ানা দেব?
উঃ- আজ ৯ই যিলহজ্জ সূর্য উদয় হওয়ার পর আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন। এর আগ পর্যন্ত মিনাতেই অবস্থান করা সুন্নত। রওয়ানা দেয়ার সময় তালবিয়াহ ও কালিমা পড়বেন ও তাকবীর বলতে থাকবেন।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ু لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ুإِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ ু لاَ شَرِيكَ لَكَ
প্রঃ ১১০- আরাফার ময়দানে হাজীদের করণীয় কাজগুলো কী কী?
উঃ- (১) আরাফায় পৌঁছে মসজিদে 'নামিরা'র কাছে অবস্থান করা মুস্তাহাব অর্থাৎ উত্তম। সেখানে জায়গা না পেলে আরাফার সীমানার ভিতরে যে কোন স্থানে অবস্থান করতে পারেন। এতে কোন অসুবিধা নেই- (মুসলিম)। তবে পাশেই 'উরানা' নামের একটি উপত্যকা আছে। সেটি আরাফার চৌহদ্দির বাইরে। কাজেই সেখানে যাবেন না। ঐখানে অবস্থান করবেন না।
(২) যুহরের সময় হলে ইমাম সাহেব খুৎবা দেবেন। খুৎবার পর যুহরের ওয়াক্তেই যুহর ও আসরের সালাত একত্রে জমা করে পড়বেন। দু' নামাযেরই আযান দেবেন একবার, কিন্তু ইকামাত দেবেন দু'বার। কসর করে পড়বেন। অর্থাৎ যুহর দু'রাকআত এবং আসরও দু'রাকআত পড়বেন। যুহরের ওয়াক্তেই আসর পড়ে ফেলবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসী ও বহিরাগত সব হাজীকে নিয়ে একত্রে এভাবে নামায পড়িয়েছিলেন। এটা সফরের কসর নয়, বরং হজ্জের কসর। কোন নফল-সুন্নাত নামায আরাফায় পড়বেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েননি।
ফর্মা-৬

(৩) মসজিদে নামিরায় যেতে না পারলে নিজ নিজ তাবুতেই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে জামা'আতের সাথে যুহর-আসর একত্রে যুহরের আউয়াল ওয়াক্তে দুই দুই রাক'আত করে কসর ও জমা করে পড়বেন।
(৪) আরাফার ময়দানের সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অবশ্যই আরাফার পরিসীমার ভিতরে অবস্থান করতে হবে। আরাফার সীমানা চিহ্নিত করে চতুষ্পার্শে অনেক পিলার দেয়া আছে। এর বাইরে অবস্থান করলে হজ্জ হবে না।
(৫) সুন্নাত হলো বেশী বেশী দোয়া করা, দোয়ার সময় হাত উঠানো, অত্যন্ত বিনম্র হওয়া, যিক্‌র করা, তাসবীহ পড়া, 'আলহাম্‌দুলিল্লাহ' ও 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পড়া, তাওবাহ করা, কান্নাকাটি করে গোনাহ মাফ চাওয়া, মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বেশী বেশী দোয়া করা।
তাছাড়া নীচের দোয়াটি আরো বেশী বেশী পড়া উত্তম :
لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهচ্ لاَ شَرِيكَ لَهচ্ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
এছাড়া নীচের তাসবীহটি বেশী বেশী পড়বেন।
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهৃ وَسُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ
এতদসঙ্গে অন্যান্য মাসনূন দোয়া সূর্যাস্ত পর্যন্ত করতে থাকবেন। সাওয়াব কমে যাবে এমন কোন কাজ করা থেকে সাবধান থাকতে হবে।
(৬) যখন সূর্য ডুবে যাবে এবং সূর্য অস্ত গিয়েছে এরূপ নিশ্চিত হবেন তখন প্রশান্ত মনে ধীরে সুস্থে মুযদালিফায় রওয়ানা দেবেন। এ সময় বেশী বেশী তালবিয়াহ পড়তে থাকবেন। সাবধান, কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা যাবে না।
প্রঃ ১১১- আরাফার দিনে হাজীদের জন্য আল্লাহ কী কী মর্যাদা ও ফযীলত রেখেছেন?
উঃ- (১) এ তারিখে দিনের বেলায়ই আল্লাহ তা'আলা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন।
(২) আল্লাহর কাছে ঐ দিনের চেয়ে উত্তম আর কোন দিন নেই।
(৩) বান্দাদের জন্য আল্লাহ তাঁর দয়ার ভাণ্ডার খুলে দেন।
(৪) সেদিন আল্লাহ বান্দাদের অতি নিকটবর্তী হন।
(৫) আরাফাতে অবস্থানকারী ও মাশআরুল হারাম- বাসীকে আল্লাহ সেদিন ক্ষমা করে দেন।
(৬) উমর রাদিআল্লাহু আনহুর প্রশ্নের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আরাফায় আগমনকারীদের জন্য এ ক্ষমা প্রদর্শন কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।
(৭) যমীনবাসীদের নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সাথে গৌরব করে বলেন, "আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ তারা ধূলিমলিন অবস্থায় এলোকেশে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে আমার রহমতের আশায়, অথচ আমার আযাব তারা দেখেনি। কাজেই আরাফার দিনে এত অধিক সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে আমি মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি যা অন্যদিন তারা পায়নি।
(৮) শয়তান ঐদিন সবচেয়ে বেশী লাঞ্ছিত, হীন ও নিকৃষ্ট বনে যায় এবং তাকে ক্রোধান্বিত দেখা যায়। বান্দাদের দোয়া কবূল ও যিক্‌রের মাধ্যমে শয়তানকে বেদনাবিধুর করে দেয়া হয়।
(৯) আল্লাহ সেদিন বলেন, এরা কি চায়? অর্থাৎ হাজীরা যা চায় তাই তিনি দিয়ে দেন।
(১০) সেদিন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং রহমত বর্ষিত হয়।
প্রঃ ১১২- দোয়াতে আল্লাহর কাছে কী কী জিনিস চাওয়া যেতে পারে?
উঃ- আপনার মনের যত সব হাজত আছে সবই তা প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন আপনার ভাষায়। এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো কিছু দোয়া আছে। বইয়ের শেষাংশে এগুলো আরবীতে ও এর বাংলা অনুবাদ দেয়া হল। দোয়াগুলো বার বার করতে থাকবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "শ্রেষ্ঠ দোয়া হচ্ছে আরাফার দিনের দোয়া।"
প্রঃ ১১৩- একটা দোয়া কতবার করা উত্তম?
উঃ- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা দোয়া সাধারণতঃ তিনবার করে করতেন। কিন্তু আরাফার মাঠে পুনরাবৃত্তি করতেন আরো বেশী পরিমাণে।
প্রঃ ১১৪- আরাফায় অবস্থান ও দোয়ার ইসলামী আদব জানতে চাই।
উঃ- আদবগুলো নিম্নরূপ :
(১) গোসল করে নেয়া,
(২) পরিপূর্ণ পবিত্র থাকা,
(৩) কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা ও অন্যান্য তাসবীহ পড়া,
(৪) দোয়া, তাসবীহ ও তাওবা-ইস্তিগফারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া,
(৫) নিজের ও অন্যদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জাহানের কল্যাণ ও মুক্তি চেয়ে দোয়া করা,
(৬) দু'হাত উঠিয়ে দোয়া করা,
(৭) মনকে বিনম্র ও খুশু-খুযু রেখে মুনাজাত করা,
(৮) দোয়াতে কণ্ঠস্বর নীচু রাখা, উচ্চঃস্বরে দোয়া না করা।
প্রঃ ১১৫- যেসব দোয়ার বইয়ে কুরআন ও হাদীসের দোয়া আছে ঐসব দোয়া কি হায়েজ অবস্থায় মহিলারা আরাফার মাঠে পড়তে পারবে?
উঃ- হাঁ, পারবে। কারণ স্ত্রীসহবাস বা স্বপদোষের কারণে যে নাপাক হয় তা ইচ্ছা করলেই নিমিষের মধ্যে গোসল করে পবিত্র হওয়া যায়। কিন্তু হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। বিষয়টি আল্লাহ্‌র হাতে এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য হায়েজ-নিফাসওয়ালী মহিলাদের জন্য কুরআন-হাদীসের এসব দোয়া পড়া জায়েয আছে।
প্রঃ ১১৬- আরাফায় অবস্থানের সময় কখন শুরু হয় এবং এর শেষ সময় কখন?
উঃ- দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলার পর থেকে আরাফার প্রকৃত সময় শুরু হয়। তবে ইমাম হাম্বলের মতে সেদিনের সকালের ফজর উদয় হওয়া থেকেই এ সময় শুরু হয়। আর এর শেষ সময় হল আরাফার দিবাগত রাত্রির ফজর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
প্রঃ ১১৭- কমপক্ষে কী পরিমাণ সময় আরাফাতে থাকতে হবে?
উঃ- দিনে অবস্থানকারীর সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
প্রঃ ১১৮- অনিবার্য কারণবশতঃ দিনের বেলায় আরাফায় যেতে পারল না। পৌঁছল ঐদিন রাতের বেলায়। ফলে শুধু রাতের অংশেই সেখানে অবস্থান করল। তার কি হজ্জ হবে?
উঃ- এক্ষেত্রে আরাফাতে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে তার হজ্জ হয়ে যাবে। মুযদালিফায় গিয়ে রাতের বাকী অংশ যাপন করবে।
প্রঃ ১১৯- কেউ যদি তার দেশ থেকে যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে এসে সরাসরি আরাফার মাঠে চলে যায় তবে কি তার হজ্জ হবে?
উঃ- হ্যাঁ, হজ্জ শুদ্ধ হবে।
প্রঃ ১২০-আরাফার দিন "জাবালে রহমতে" উঠার কোন বিশেষ সাওয়াব আছে কি?
উঃ- না, সেখানে আরোহণ করে ইবাদত ও দোয়া-তাসবীহ পাঠে সাওয়াব বেশী হওয়ার কথা কুরআন-হাদীসে নেই।
প্রঃ ১২১- আরাফার মাঠে হাজীদের আরাফার রোযা রাখার বিধান কি?
উঃ- আরাফার দিন রোযা রাখা অত্যন্ত সাওয়াবের বিষয় হলেও আরাফায় অবস্থানকারী হাজীগণ এ রোযা রাখবে না। বিশেষ করে মাঠে অবস্থানকারী হাজীদের জন্য ঐ দিন রোযা না রাখা মুস্তাহাব, অর্থাৎ রোযা না রাখাই বিধান। কারণ খানাপিনা না খেলে এ কঠিন ইবাদতের জন্য শরীরে শক্তি পাবে না। হজ্জের এ পরিশ্রান্ত ইবাদত যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য শক্তির প্রয়োজন। তাই খাবার গ্রহণ করা জরুরী।
প্রঃ ১২২- আরাফার দিন ঐ ময়দানে সুন্নাত-নফল সালাত পড়বে কি?
উঃ- না, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় শুধুমাত্র ফরয পড়ে দোয়ায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
প্রঃ ১২৩- যদি আরাফার মাঠে কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়ে যায় তখন সে কী করবে?
উঃ- অন্যান্য হাজীরা যা যা করবে উক্ত মহিলাও তাই করবে। পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শুধুমাত্র নামায পড়বে না এবং কাবা তাওয়াফ করবে না।
প্রঃ ১২৪-কোন কারণবশতঃ কেউ যদি অযু বিহীন বা অপবিত্র থাকে তবে তার আরাফায় অবস্থান কি শুদ্ধ হবে?
উঃ- হ্যাঁ, শুদ্ধ হবে।
প্রশ্নঃ ১২৫- শুক্রবারে হজ্জ হলে আরাফায় জুমা নাকি যুহর পড়ব?
উঃ-যুহর পড়বেন।
প্রঃ ১২৬- মানুষ আরাফার মাঠে সাধারণতঃ কী ধরনের ভুল-ত্রুটি করে থাকে?
উঃ- হাজীদের যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি সাধারণতঃ পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নরূপ :
(১) কিছু লোক আরাফার সীমানার বাইরে বসে থাকে। অথচ আরাফার সীমানা চিহ্নিত খুঁটি চতুর্দিকেই দেয়া আছে। এ কাজে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
(২) কিছু হাজী পাহাড়ে গিয়ে ভীড় জমায়, এর পাথর ছুঁয়ে গায়ে মুছে। এগুলো শির্ক বিদ'আতের অন্তর্ভুক্ত।
(৩) কিছু কিছু হাজী অনর্থক কথাবার্তা, গল্পগুজব ও হাসাহাসি করে দোয়া কালাম পড়া থেকে বিরত থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট করে হজ্জকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
(৪) আবার কেউ কেউ দোয়ার সময় কেবলামুখী না হয়ে জাবালে রহমত পাহাড় মুখী হয়ে দোয়া করে। অথচ সুন্নাত হলো কাবার দিকে মুখ করে দোয়া করা।
(৫) আরেকটি বড় ভুল হলো এই যে, কিছু হাজী সূর্য ডুবার আগেই আরাফার ময়দান ছেড়ে চলে যায়। এটা জায়েয নয়।
(৬) আবার কিছু হাজী ফজরের আগেই মিনা থেকে আরাফায় রওয়ানা দেয়। সুন্নত হলো সূর্যোদয়ের পর রওয়ানা দেয়া।
(৭) মসজিদে নামিরায় জামাআত না পেলে যুহর-আসর একত্রে না পড়ে পৃথক পৃথক ওয়াক্তে আদায় করে। এটাও ঠিক নয়।
(৮) আরাফায় যুহর-আসর একত্রে পড়া ও দুই দুই রাক'আত করে কসর করা জায়েয মনে না করা। এটা ভুল ধারণা।

প্রঃ ১২৭- কখন কিভাবে মুযদালিফায় রওয়ানা দেব?
উঃ- সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাতে মাগরিবের নামায না পড়ে মুযদালিফায় রওয়ানা দেবেন। পৌঁছতে দেরী হলেও মাগরিব-এশা মুযদালিফায়ই পড়তে হবে। এ দেরীকে কাযা মনে করবেন না। সেদিনের জন্য এটাই নিয়ম। সেখানে যাওয়ার সময় মোয়াল্লেমের গাড়ীতে বা কয়েকজন মিলে একজনকে গ্রুপলীডার বানিয়ে তার নেতৃত্বে দল বেঁধে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে পথ চলতে পারেন। পথে যাতে হারিয়ে না যান, কেউ যাতে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সেজন্য গ্রুপলীডার একটি বাংলাদেশী পতাকা কাঁধে নিয়ে চলতে পারেন। সেখানেও ভীড় হয়। ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকবেন। সাথে নারী-শিশু থাকলে আরো বেশী সাবধান থাকবেন। ভীড়ের কারণে শোয়ার জন্য খালী ভাল জায়গা অনেক সময় পাওয়া যায় না। টয়লেটেও প্রচুর ভীড় হয়। দেখে-শুনে শোয়ার জায়গা বেছে নেবেন।
১২শ অধ্যায়
المبيت بمزدلفة
মুযদালিফায় রাত্রি যাপন

প্রঃ ১২৮- মুযদালিফায় রাত্রিযাপনের হুকুম কি?
উঃ- এটা ওয়াজিব। এটা করতেই হবে।
প্রঃ ১২৯- মুযদালিফায় কখন মাগরিব ও এশা পড়ব এবং কিভাবে পড়ব?
উঃ-(১) বিলম্ব হলেও মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব-এশা পড়তে হবে, এর আগে নয়। তবে এ দুই নামাযকে বিলম্ব করতে করতে অর্ধ রাত্রির পরে নিয়ে যাওয়া জায়েয হবে না। তবে ওযর থাকলে জায়েয।
(২) তারতীব ঠিক রেখে সালাত আদায় করবেন। অর্থাৎ প্রথম তিন রাক'আত মাগরিবের ফরজ এবং এর সাথে সাথে দুই রাক'আত এশার ফরজ আদায় করবেন, বিত্‌র পড়বেন, ফজরের সুন্নাতও বাদ দেবেন না।
(৩) এ দুই ওয়াক্ত সালাতের জন্য মাত্র একবার আযান দেবেন। কিন্তু ইকামত দুই বারই দিতে হবে।
(৪) কোন নফল-সুন্নাত নামায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় পড়েননি। আপনিও পড়বেন না।
(৫) সালাত আদায় শেষ হওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়বেন যাতে পরবর্তী দিনের কার্যাবলী সক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়।
(৬) ঐ দিনের ফজর অন্ধকার থাকতেই আউয়াল ওয়াক্তে পড়ে নেবেন। দুই রাকাত ফরজের সাথে দুই রাকাত সুন্নতও পড়বেন। এরপর "মাশআরুল হারাম"-এর নিকটবর্তী কিবলামুখী দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দোয়া-মুনাজাত করতে থাকবেন। এখানে আসতে না পারলে অসুবিধা নেই। মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে দোয়া করতে পারবেন।
প্রঃ ১৩০- "মাশআরুল হারাম" কী? এটা কোথায়? এখানে হাজীদের কী কী কাজ সুন্নাত?
উঃ- "মাশআরুল হারাম" একটি পাহাড়ের নাম। এটি মুযদালিফায় অবস্থিত। এখানে একটি মসজিদও আছে। এখানে হাজীদের যা করণীয় তা হল : (১) মাশআরুল হারামের নিকট কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো, (২) তাকবীর বলা, (৩) তাসবীহ-তাহলীল পড়া অর্থাৎ 'সুবহানাল্লাহ', 'আলহাম্‌দু লিল্লাহ' এবং 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু' পড়া। (৪) যিক্‌র করা এবং (৫) প্রাণ খুলে আল্লাহ তা'আলার কাছে দোয়া করা, (৬) খুশু-খুযু ও বিনম্র হয়ে মাবুদের কাছে আপনার যা চাওয়ার আছে তা চেয়ে নেবেন। বিশেষ করে আপনার মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-সন্তানাদি ও আপনজন-আত্মীয়স্বজনের জন্যও দোয়া করবেন।
(৭) দোয়ার সময় দু' হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব।
এভাবে ফজরের নামাযের পর থেকে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া করতে থাকা মুস্তাহাব। ভীড়ের কারণে "মাশআরুল হারাম"-এর কাছে যেতে না পারলে মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে এভাবে দোয়া করবেন।
প্রঃ ১৩১- মুযদালিফায় কতক্ষণ পর্যন্ত রত্রিযাপন করব এবং কখন মিনায় রওয়ানা দেব?
উঃ- ফজরের সালাত আদায় না করা পর্যন্ত মুযদালিফায় থাকতে হবে। ফজরের সালাত শেষে তাসবীহ-তাহলীল ও দোয়ার পালা। আকাশ ফর্সা হয়ে গেলে সূর্য উঠার আগেই মিনায় রওয়ানা দেবেন। প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে ট্রাফিক জামের দরুন বাসের অপেক্ষা না করে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেয়াই ভাল।
প্রঃ ১৩২- দুর্বল নারী ও শিশুরা কি অর্ধ রাত্রির পর মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় চলে যেতে পারবে?
উঃ- হ্যাঁ, দুর্বল নারী ও শিশু এবং অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য অর্ধ রাত্রির পর মুযদালিফা থেকে মিনায় চলে যাওয়া জায়েয হবে। দুর্বল ও অসুস্থদের সাহায্যার্থে তাদের সাথে সুস্থ অভিভাবকরাও যেতে পারবে। এরূপ ওযর ছাড়া মুযদালিফায় ফজর আদায় না করে কারো মিনায় চলে যাওয়া ঠিক হবে না। চলে গেলে দম দিতে হবে।
প্রঃ ১৩৩- কখন কংকর সংগ্রহ করব?
উঃ- "মাশআরুল হারাম" থেকে মিনায় যাবার সময় কংকর সংগ্রহ করা যায়।
প্রঃ ১৩৪- কোথা থেকে কংকর কুড়ানো যায়?
উঃ- সুন্নাত হলো প্রথম দিনের ৭টি কংকর মাশআরুল হারাম থেকে রওয়ানা দেয়ার পর মুযদালিফা থেকেই কুড়াবেন। এখান থেকে এর বেশী নয়। আর বাকী ৩ দিনের প্রত্যেক দিনের ২১টি করে কংকর মিনা থেকেই কুড়ানো যায়। এটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। তবে হারামের মধ্যবর্তী যে কোন স্থান থেকেই কংকর কুড়ানো জায়েয আছে।
প্রঃ ১৩৫- মুযদালিফা থেকে মিনা রওয়ানা কালে হাজীদের করণীয় কাজ কী কী?
উঃ- চলার সময় বেশী বেশী লাব্বাইকা অর্থাৎ তালবিয়াহ ও আল্লাহু আকবার পড়তে থাকবেন। ওয়াদি মুহাস্‌সির (وادي محسر) নামক স্থানে পৌঁছলে সামান্য দ্রুত গতিতে হাঁটা মুস্তাহাব, যদি অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়া ছাড়া এটি করা যায়, তবেই তা করবেন। "ওয়াদী মুহাস্‌সির" নামক জায়গাটি মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি উপত্যকার নাম। উল্লেখ্য যে, বড় জামারায় পৌঁছা মাত্র তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দেবেন।
প্রঃ ১৩৬- মুযদালিফায় সাধারণতঃ কী কী সমস্যা হয়ে থাকে এবং এ থেকে সমাধানের উপায় কী?
উঃ- আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফায় ফিরে আসার মুহুর্তটি বেশ কঠিন। সূর্যাস্তের পর পরই ত্রিশ/চল্লিশ লক্ষ লোক এক সময়ে একযোগে আরাফা থেকে মুযদালিফায় রওয়ানা দেয়। বাসের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত থাকলেও রাস্তাতো সীমিত। পাহাড়ী উপত্যকা বেয়ে তিন/চার মিলিয়ন মানুষের লক্ষাধিক বাস গাড়ী একসাথে চললে ট্রাফিকজ্যাম কতটা কঠিন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মাঝে মধ্যে গাড়ীগুলো এমনভাবে থেমে থাকে মনে হয় যেন আর চলবে না। তাছাড়া বেশির ভাগ ড্রাইভার বিদেশী ও নতুন। রাস্তাঘাট ভাল চেনে না, কথা বলে আরবীতে, আমরা তা বুঝিনা। "সব রাস্তা বন্ধ, গাড়ী আর চলবে না।" -এ কথা বলে কখনো কখনো আবার গাড়ী থেকে হাজী সাহেবদেরকে নামিয়ে দেয়। আরাফা থেকে মুযদালিফার দূরত্ব মাত্র ৬/৭ কিলোমিটার হলেও কিছু গাড়ী ফজরের আগে মুযদালিফায় পৌঁছতেই পারে না। তাছাড়া মুযদালিফা এসে গেছে ধারণা করে কিছু লোক দেখাদেখি মাঝপথে মাগরিব এশা পড়ে ও রাত্রি যাপন করে। অবশেষে ফজর বাদ মুযদালিফার সীমানায় এসে সাইনবোর্ড দেখে তাদের ভুল বুঝতে পেরে আক্ষেপ করে। এভাবে হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় অনেক হাজীর। অতি বৃদ্ধ, দুর্বল ও রোগী না হলে এ জন্য সহজ হল আরাফা থেকে পায়ে হেঁটে মুযদালিফায় আসা। সেজন্য মাদুর ও ছোট এক/দুটা হালকা বিছানা পত্র ছাড়া ভারী কোন লাগেজ আরাফায় না নেয়াই ভাল। শুধু হাঁটার জন্য আলাদা পথ রয়েছে, যা সমতল ও পীচ ঢালা। এ পথে কোন যানবাহন ঢুকেনা। তাই হাঁটতে বেশ আরাম। রাস্তায় পর্যাপ্ত বাতি থাকে। মেঘবৃষ্টি সাধারণতঃ হয় না। আবহাওয়া থাকে ভাল। সকলেই একযোগে একমুখী চলা। সবার মুখে একই তালবিয়া "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক..." প্রয়োজনে রাস্তার পাশে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে পারেন। দলবদ্ধ হয়ে পথ চললে ভাল হয়। ভীড়ের কারণে এ সময় কিছু লোক হারিয়েও যায়। সে জন্য খুব সতর্ক থাকবেন। সাথে শিশু ও নারী থাকলে আরো সাবধান থাকবেন।" নতুবা নারী-শিশুদেরকে বাসেই আনবেন। মুযদালিফার সীমানায় পৌঁছলে সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। যেখানে লেখা আছে-
Muzdalifa Starts Here
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখান থেকে শুরু)
আর এ এলাকা শেষ হলে দেখতে পাবেন সীমানা চি‎িহ্নত
আরেকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা পাবেন,
Muzdalifa Ends Here
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখানে শেষ)
দিন দিন হাজীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখানে শোয়ার যায়গা পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। সমতল বা ঢালু যাই পান একটা সুবিধাজনক স্থান বাছাই করে কয়েকজনে মিলে জামায়াতের সাথে মাগরিব-এশার সালাত আদায় করে নেবেন। সারা রাত প্রতিটি টয়লেটের সামনে ১০/১২ জনের দীর্ঘ লাইন লেগেই থাকে। এজন্য পানি কম খাওয়া ভাল। শোয়ার জন্য এটা কোন আরাম দায়ক স্থান নয়। এটা ইবাদতের স্থান। গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার স্থান। বালু কণা আর পাথরের টুকরা যাই থাকুক এরই উপর একটি মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে পড়বেন। ভুলে যাবেন নিজের অর্থবিত্ত ও পদমর্যাদার গৌরব। ধনী গরীব মিলে মিশে সকলেই একসাথে একাকার হয়ে যাবেন। আপনার নিবেদন শুধু একটাই "হে আল্লাহ আমাকে তুমি মাফ করে দাও।"
ভোরে মুযদালিফা থেকে পায়ে হেঁটে মিনায় পৌঁছতে হবে। গাড়ীতে যাওয়ার সুযোগ হয় না বললেই চলে। কারণ মানুষের ঢলের কারণে গাড়ী চলা দুরূহ হয়ে পড়ে। সেদিনের দীর্ঘ হাঁটা, ক্লান্তি ও সঙ্গী সাথী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সমস্যা, ইত্যকার যাবতীয় কষ্ট বরণ করে নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন। কত নম্বর খুঁটির নিকটে মিনায় আপনার তাঁবু তা আগে থেকেই জেনে রাখুন। কারণ এখান থেকে হারিয়ে গেলে জনরাশির মহাস্রোতে আপনাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন। মিনায় তাঁবুতে পৌঁছে নাস্তা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পরে কংকর নিক্ষেপ করতে যেতে পারেন। এর পূর্বে কংকর নিক্ষেপের মাসআলাগুলো আবার একটু পড়ে নিন।

১৩শ অধ্যায়
 رَمْيُ الْجِمَارِ
কংকর নিক্ষেপ

প্রঃ ১৩৭- ১০ই যিলহজ্জ অর্থাৎ ঈদের দিনে আমাদের কী কী কাজ আছে?
উঃ- নিম্নবর্ণিত ৪টি কাজ :
(১) কংকর নিক্ষেপ [শুধুমাত্র বড় জামারায়], (২) কুরবানী করা, (৩) চুল কাটা (৪) তাওয়াফ করা অর্থাৎ তাওয়াফুল ইফাদা বা ফরয তাওয়াফ। এ দিনে না পারলে পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে বা অন্য যে কোন সময় করলেও চলবে।
প্রঃ ১৩৮- আজকের ঈদের দিনে কোন কাজটি প্রথমে করব?
উঃ- বড় জামারায় ৭টি কংকর মারা। মুস্তাহাব হলো এর আগে অন্য কোন কাজ না করা।
প্রঃ ১৩৯- "বড় জামারা" কোন্‌টি?
উঃ- হারাম শরীফ থেকে মিনায় আসলে ঐ পথে যেটা কাবার নিকটতম সেটাই বড় জামরা।
প্রঃ ১৪০- কংকর নিক্ষেপের হেকমত কি?
উঃ- আল্লাহ তা'আলার যিক্‌র কায়েম করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ এবং জামারায় পাথর নিক্ষেপ আল্লাহ তা'আলার যিক্‌র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই করা হয়েছে। (তিরমিযী)
প্রঃ ১৪১- জামারায় কংকর মারার হুকুম কি?
উঃ- ওয়াজিব। এটা ছুটে গেলে দম দিতে হবে।
প্রঃ ১৪২- ১১ এবং ১২ যিলহজ্জ তারিখে প্রতিটি "জামারায়" প্রতিবারে কয়টি কংকর মারতে হয়?
উঃ- ৭টি করে তিনটি জামারায় মোট (৭দ্ধ৩)=২১টি কংকর।
প্রঃ ১৪৩- প্রথমদিন অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্জ তারিখে 'বড় জামারায়' পাথর নিক্ষেপের সময় কখন শুরু হয়?
উঃ- সূর্যোদয়ের পর থেকে কংকর মারা উত্তম। ফজরের আউয়াল ওয়াক্ত থেকে সূর্য উঠার আগেও পাথর নিক্ষেপ জায়েয আছে। দুর্বল, শিশু, নারী ও অক্ষম ব্যক্তিরা মধ্যরাত্রির পর থেকে কংকর মারা শুরু করতে পারে।
প্রঃ ১৪৪- প্রথমদিন কংকর নিক্ষেপের শেষ সময় কখন?
উঃ- ঐদিনে কংকর নিক্ষেপের উত্তম সময় হল সূর্যোদয় থেকে শুরু করে দুপুরে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত মারাও জায়েয আছে। কারণবশতঃ সন্ধ্যার পর থেকে ঐ দিবাগত রাতের ফজর উদয় হওয়ার আগেও যদি মারে তবু চলবে। তবে এ সময়ে মাকরূহ হবে।
প্রঃ ১৪৫- কংকর নিক্ষেপের শর্ত কয়টি ও কি কি?
উঃ- শর্তগুলো নিম্নরূপ :
(১) জামারার খুঁটিকে লক্ষ্য করে কংকর ছুঁড়ে মারতে হবে। অন্যদিকে টার্গেট করে মারলে খুঁটিতে লাগলেও শুদ্ধ হবে না।
(২) ঢিলটি জোরে নিক্ষেপ করতে হবে। সাধারণভাবে কংকরটি সেখানে শুধু ছুয়ায়ে দিলে হবে না।
(৩) কংকরটি পাথর হতে হবে। মাটি বা ইটের টুকরা দিয়ে হবে না।
(৪) কংকরটি হাত দিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের খেলনা, গুলাল, তীর বা পা দিয়ে লাথি মেরে নিক্ষেপ করলে হবে না।
(৫) সাতটি পাথর হাতের মুঠোয় ভরে একেবারে নয় বরং একটি একটি কংকর হাতে নিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে।
(৬) ব্যবহৃত কংকর পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না।
(৭) ওয়াক্ত হলে কংকর নিক্ষেপ করা। এর আগে পরে নয়।
প্রঃ ১৪৬- কংকর নিক্ষেপের সুন্নাত তরীকাগুলো কি কি?
উঃ- এগুলো নিম্নরূপ :
(১) মিনায় প্রবেশ করে কংকর নিক্ষেপের আগে অন্য কিছু না করা।
(২) কংকর নিক্ষেপ শুরু করার পূর্বে তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দেয়া।
(৩) প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় "আল্লাহু আকবার" বলা। ডান হাতে নিক্ষেপ করা। পুরুষের হাত উঁচু করে নিক্ষেপ করা। মেয়েরা হাত উঁচু করবে না।
(৪) কংকরের সাইজ হবে গুলালের গুলির কাছাকাছি বা চানা বুটের দানার চেয়ে একটু বড়।
(৫) প্রথমদিন সূর্যোদয়ের পরে মারা সুন্নাত।
(৬) দাঁড়ানোর সুন্নত হলো মক্কাকে বামপাশে এবং মিনাকে ডানে রেখে 'জামারার' দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। এরপর নিক্ষেপ করবে। প্রচণ্ড ভীড় হলে যে কোন দিকে দাঁড়িয়েও মারতে পারেন।
(৭) একটা কংকর মারার পর আরেকটি মারা। অর্থাৎ দুই কংকরের মধ্যে বেশী সময় না নেয়া।
(৮) কংকরগুলো পবিত্র হওয়া মুস্তাহাব। অপবিত্র হলেও তা দিয়ে নিক্ষেপ করা যাবে। তবে মাকরূহ হবে।
প্রঃ ১৪৭- আইয়্যামে তাশরীকের দিনগুলোতে পাথর নিক্ষেপের হুকুম কি?
উঃ- ওয়াজিব। এটা বাদ গেলে দম দিতে হবে। আইয়্যামে তাশরীক হল ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ।
প্রঃ ১৪৮- উপরে বর্ণিত ৩ দিনে কংকর নিক্ষেপ কখন শুরু করব?
উঃ- দুপুরের পর থেকে। এর আগে জায়েয নয়।
প্রঃ ১৪৯- এ ৩ দিনে পাথর নিক্ষেপের শেষ সময় কখন?
উঃ- সুন্নাত হলো সূর্য ডুবার পূর্ব পর্যন্ত। তবে রাতেও মারা যাবে অর্থাৎ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত জায়েয আছে।
প্রঃ ১৫০- ১২ই যিলহজ্জ কংকর নিক্ষেপ করে যদি সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করতে না পারে তাহলে এর বিধান কি?
উঃ- ঐ দিন মিনাতেই রাত্রিযাপন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। পরের দিন ১৩ই যিলহজ্জ দুপুরের পর ৩টি জামারাকে আরো ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে পরে মিনা ত্যাগ করতে হবে।
প্রঃ ১৫১- যারা ১২ তারিখে সন্ধ্যার পূর্বে মিনা ত্যাগ করতে পারেনি তারা কি ১৩ তারিখে দুপুরের আগে পাথর মারতে পারবে?
উঃ- ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মতে মারা জায়েয আছে। কিন্তু একই মাযহাবের তাঁরই দুজন সঙ্গী ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে দুপুরে সূর্য ঢলার আগে কংকর নিক্ষেপ জায়েয হবে না। কাজেই দুপুরের আগে নিক্ষেপ না করাই উত্তম।
প্রঃ ১৫২- প্রথমে ছোট, এরপর মধ্যম এবং সর্বশেষে বড় জামারায় কংকর নিক্ষেপে তারতীব অর্থাৎ সিরিয়াল ঠিক রাখার বিধান কি?
উঃ- সিরিয়াল ঠিক রাখা ওয়াজিব। হানাফী মাযহাবে সুন্নাত।
প্রঃ ১৫৩- আইয়্যামে তাশরীকের (অর্থাৎ ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ তারিখে) কংকর নিক্ষেপের সুন্নাত তরীকাগুলো কী কী?
উঃ- তরীকাগুলো নিম্নরূপ :
(১) দুপুর হলে পরে কংকর নিক্ষেপ আগে, এরপর যুহরের সালাত আদায় এভাবে সিরিয়াল করা মুস্‌তাহাব। (বুখারী) প্রচণ্ড ভীড় থাকে বিধায় এ সিরিয়াল ঠিক রাখার চেষ্টা না করাই ভাল।
(২) মিনার মসজিদে 'খায়েফ' থেকে কাবার দিকে অগ্রসর হলে প্রথমে ছোট এরপর মধ্যম এবং শেষে বড় জামরা দেখতে পাবেন। আগে ছোট 'জামারায়' কংকর নিক্ষেপ করে এটাকে বামে রেখে এখান থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে কিবলামুখী হয় দাঁড়িয়ে 'আলহামদুলিল্লাহ', 'আল্লাহু আকবার', 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পড়বেন এবং দু'হাত উঠিয়ে দোয়া করবেন।
(৩) এরপর যাবেন মধ্যম 'জামারায়'। এখানেও পূর্বের মত 'আল্লাহু আকবার' বলে প্রতিটি কংকর নিক্ষেপ করবেন এবং পরে 'আলহামদুলিল্লাহ' আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পড়বেন এবং কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দু'হাত উঠিয়ে আরবীতে বাংলায় যত পারেন লম্বা মুনাজাত করবেন। একাকি মুনাজাত করাই সুন্নাত।
(৪) সবশেষে বড় জামরায় এসে ৭টি কংকর মেরে আর থামবেন না সেখানে। জামারা ত্যাগ করবেন। একই নিয়মে শেষ ৩ দিন প্রতিদিন ৭+৭+৭= ২১টি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন।
প্রঃ ১৫৪- কংকরটি হাউজের মধ্যে পড়ল কিনা যদি এমন সন্দেহ হয় তাহলে কী করতে হবে?
উঃ- যে কটা সন্দেহ হবে সে কটা আবার মারতে হবে। কংকর হাউজের বাইরে পড়লে ঐ পাথর পুনরায় মারতে হবে।
প্রঃ ১৫৫- যদি এক বা একাধিক কংকর কম নিক্ষেপ করে থাকে তবে তার বিধান কী?
উঃ- প্রতিটি কংকরের জন্য অর্ধেক সাআ (অর্থাৎ এক কেজি বিশ গ্রাম) পরিমাণ গম, খেজুর বা ভুট্টা দান করতে হবে। আর ঘাটতি কংকরের সংখ্যা ৩ এর অধিক হলে দম দিতে হবে।
প্রঃ ১৫৬- কোন্‌ ধরনের হাজীদের পক্ষে বদলী পাথর নিক্ষেপ জায়েয আছে?
উঃ- দুর্বল, রোগী, অতি বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য।
প্রঃ ১৫৭- কোন্‌ কোন্‌ শর্তে বদলী কংকর নিক্ষেপ জায়েয হবে?
উঃ-(১) যিনি বদলী মারবেন তিনি একই বছরের হাজী হতে হবে।
(২) যার পরিবর্তে বদলী মারবেন তিনি অবশ্যই অক্ষম ব্যক্তি হতে হবে।
(৩) প্রথমে হাজী নিজের পাথর মারবেন, এরপর অক্ষম ব্যক্তির কংকর মারবেন।
প্রঃ ১৫৮- 'জামারাগুলোকে' শয়তান অর্থে ব্যবহারের একটা প্রচলন আছে। অর্থাৎ বড় শয়তান, মধ্যম শয়তান ও ছোট শয়তান বলা হয়, এরূপ নামকরণ কি ঠিক আছে?
উঃ- না, ঠিক নয়। এ ৩টি জামারা শয়তানের প্রতিভূ বা চিহ্ন নয়। এগুলোকে পাথর নিক্ষেপ করলে শয়তানকে পাথর মারা হয়, এ কথাও ঠিক নয়। এটা একটা ভুল ধারণা ও বিভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস। একটা ভুল অনুভূতি নিয়ে জামারাগুলোকে কংকর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবাবেগের পরিবর্তন হয়ে যায়, বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ফলে নানা অঘটনও ঘটে যায়। আসুন আমরা ভুল আকীদা পরিহার করি।
প্রঃ ১৫৯- কংকর নিক্ষেপকালে কি কি ত্রুটি হাজীগণ সচরাচর করে থাকেন?
উঃ- নিম্নবর্ণিত ভুল ত্রুটি লক্ষ্য করা যায় :
(১) ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ দুপুরের আগেই কংকর নিক্ষেপ করে থাকে। এ কাজটা ভুল। সময় শুরু হয় দুপুরের পর থেকে।
(২) মুযদালিফা থেকেই কংকর কুড়াতে হবে, এ ধারণা ভুল।
(৩) কেউ কেউ কংকর ধৌত করে থাকে। এ কাজ ঠিক না।
(৪) ধাক্কাধাক্কি করে অন্য হাজীদেরকে কষ্ট দিয়ে কংকর নিক্ষেপ করে থাকে। এরূপ করা অন্যায়।
(৫) ক্ষিপ্ত হয়ে কোন কোন হাজী বড় পাথর, জুতা, ছাতা ও কাঠ দিয়ে ঢিল ছুড়ে। এরূপ মারা জায়েয নয়।

১৪শ অধ্যায়
 الهدي
হাদী (পশু জবাই), কুরবানী, দম

প্রঃ ১৬০-হাদী ও কুরবানীর মধ্যে পার্থক্য কী?
উঃ- হজ্জের জন্য যে পশু জবাই হয় তা হল হাদী এবং ঈদুল আযহায় যে পশু জবাই হয় সেটি হচ্ছে কুরবানী।
প্রঃ ১৬১- হাজীদের জন্য হাদী জবাইয়ের হুকুম কী?
উঃ- এটা ওয়াজিব। হাদীকে দমে শুক্‌রও বলা হয়।
প্রঃ ১৬২- কোন্‌ দুই শ্রেণীর হাজীদের জন্য হাদী ওয়াজিব?
উঃ- তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য।
প্রঃ ১৬৩- তামাত্তু ও কিরান হাজীগণ যদি মক্কার অধিবাসী হয় তাহলে কি হাদী জবাই করতে হবে?
উঃ- না, এক্ষেত্রে হাদী লাগবে না। এমনকি রোযাও রাখতে হবে না।
প্রঃ ১৬৪- বহিরাগত যেসব লোক চাকুরী বা পড়াশুনা বা অন্য কোন কারণে মক্কা শরীফে অবস্থান করছেন তারা কি মক্কার বাসিন্দা বলে গণ্য হবেন?
উঃ- হাঁ। তারা মাক্কার বাসিন্দা বলে গণ্য হবেন।
প্রঃ ১৬৫- হাদী ও কুরবানী কোথায় এবং কীভাবে দিতে হয়?
উঃ- হাদী মিনায় বা মক্কায় জবাই করা ওয়াজিব। আর কুরবানী নিজ দেশেও দেয়া যাবে। সৌদী আরব সরকারের তত্ত্বাবধানে আই.ডি.বি-র মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর যাবৎ কুরবানী ও হাদীর পশু ক্রয়-বিক্রয়, আমদানী ও জবাই হয়ে থাকে। হাজীরা এখন এ সুযোগ নিয়ে তাদের মুয়াল্লেম বা গ্রুপলীডারের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে হাদীর পশু ক্রয় ও জবাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। আপনিও তাই দূর-দূরান্ত, অজানা-অচেনা পথে অতীব পরিশ্রমের ঝুকি না নিয়ে পূর্বেই ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে হাদীর পশু জবাইয়ের কাজটা সহজে সেরে ফেলতে পারেন। ফলে পাথর মারা শেষ হলে আপনার পরবর্তী কাজ হবে চুল কাটা।
প্রঃ ১৬৬- হাজীদের জন্য হাদী ও কুরবানীর ও হুকুম কী?
উঃ- হাজীদের জন্য হাদী ওয়াজিব, কিন্তু কুরবানী সুন্নাত।
প্রঃ ১৬৭-দম কোথায় দিতে হয়? এর গোশত কারা খাবে?
উঃ- মিনায় বা মাক্কায় দিতে হয়। এর গোশত শুধুমাত্র ফকীর-মিসকীনরা খাবে। দম দাতা এর গোশত খেতে পারবে না।
প্রঃ ১৬৮- হাদী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও প্রাথমিক কিছু মাসআলা জানতে চাই?
উঃ- মাসআলাগুলো নিম্নরূপ :
(১) পাথর মারা শেষ হলেই পশু জবাই করতে হয়।
(২) পশু জবাইয়ের সময় শুরু হয় ১০ই যিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর থেকে ১৩ই যিলহজ্জ সূর্য ডুবার পূর্ব পর্যন্ত।
(৩) মিনা বা মক্কা উভয় স্থানেই পশু জবাই করা জায়েয।
(৪) পশুটি নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে।
(৫) একজন ব্যক্তি তার নিজের জন্য একাধিক হাদী ও কুরবানী জবাই করতে পারবেন।
(৬) আবার গরু বা উট হলে এক পশুতে ৭ জন শরীক হতে পারবেন।
(৭) জবাইয়ের সময় পশুকে কেবলামুখী করে জবাই করতে হবে।
(৮) পশুটিকে বাম কাত করে ফেলে ডান পাশে পাঁ রেখে মজবুত করে চেপে ধরে জবাই করবেন।
(৯) জবাইর সময় বলবেন, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।
(১০) কুরবানীর গোশ্‌ত নিজে খাওয়া, বিতরণ ও দান করা সবই সুন্নাত এবং জমা রাখা জায়িয।
(১১) তিন ভাগের একভাগ গোশ্‌ত গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণকালে ভাগের মধ্যে পরিমাণে একটু কম-বেশী হলে অসুবিধা নেই।
(১২) অপরিচিত সংস্থা বা অজানা অবিশ্বস্ত লোকের কাছ থেকে কুরবানীর রসিদ কাটবেন না।
প্রঃ ১৬৯:- হাদীর টাকা যারা ব্যাংকে জমা দেয় কোন কারণে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে তাদের চুল কাটার পর যদি যে পশু যবাই হয় তাহলে কি কোন ক্ষতি হবে?
উঃ- ওযর থাকলে কোন অসুবিধা নেই।

১৫শ অধ্যায়
طواف إفاضة
তাওয়াফে ইফাদা 

প্রঃ ১৭০- তাওয়াফে ইফাদার হুকুম কি?
উঃ- এ তাওয়াফটি হজ্জের একটা রুক্‌ন অর্থাৎ ফরজ। এটা ছুটে গেলে হজ্জ হবে না। তাওয়াফে ইফাদার অপর নাম তাওয়াফে যিয়ারাহ বা ফরয তাওয়াফ।
প্রঃ ১৭১- তাওয়াফে ইফাদার সময় কখন শুরু হয়?
উঃ- উত্তম সময় হলো ১০ই যিলহজ্জ ঈদের দিন কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী করা ও চুল কাটার পর তাওয়াফে ইফাদা করা। তবে সেদিন ফজর উদয় হওয়ার পরই তাওয়াফে ইফাদার সময় শুরু হয়ে যায়।
প্রঃ ১৭২- এ তাওয়াফের শেষ সময় কখন?
উঃ- ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ)-এর মতে ১০, ১১ ও ১২ই যিলহজ্জ-এ ৩ দিনের যে কোন দিন বা রাতে তাওয়াফে ইফাদা করে ফেলা ওয়াজিব। এ সময়ের মধ্যে না পারলে দম দিতে হবে। পক্ষান্তরে একই মাযহাবের ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে ১২ই যিলহজ্জের পরও যে কোন দিন তাওয়াফে ইফাদা করা যায়। এজন্য কোন প্রকার দম দেয়া লাগবে না, (البدائع الصنائع) এ সময়ে তাওয়াফ ও সাঈতে প্রচণ্ড ভীড় হয় বিধায় বৃদ্ধ, অসুস্থ, শিশু, নারী ও অক্ষম হাজীদের দু'তিন দিন পর তাওয়াফ-সাঈ করা ভাল মনে করছি।
প্রঃ ১৭৩- তাওয়াফে ইফাদার নিয়ম কি?
উঃ- এ তাওয়াফ উমরার তাওয়াফের মতই। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ৭ম অধ্যায়ে দেখুন।
প্রঃ ১৭৪- তাওয়াফে ইফাদা শেষে যে সাঈ করা হয় তার হুকুম ও নিয়ম কি?
উঃ- উক্ত সাঈ ওয়াজিব। কেউ কেউ বলেছেন এটা ফরয। উমরার সাঈর মতই এ সাঈ। যে কোন পোষাক পরে এ সাঈ করা যায়। বিস্তারিত দেখুন পূর্ববর্তী ৮ম অধ্যায়ে।

১৬শ অধ্যায়
المبيت بمنى
মিনায় রাত্রিযাপন 

প্রঃ ১৭৫- মিনায় রাত্রি যাপনের হুকুম কি?
উঃ- মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবসহ অধিকাংশ বিজ্ঞ উলামাদের মতে মিনায় রাত্রিযাপন ওয়াজিব। বিনা ওজরে এটি ছুটে গেলে দম দিতে হবে। তবে হানাফী মাযহাবে এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আর এ সুন্নাত ছুটে গেলে দম দেয়া লাগে না।
প্রঃ ১৭৬- কোন্‌ কোন্‌ রাত্রি মিনায় যাপন করা ওয়াজিব?
উঃ- ১০ ও ১১ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় থাকা ওয়াজিব। ১২ই যিলহজ্জ তারিখে পাথর নিক্ষেপ শেষে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ঐ তারিখের দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়।
প্রঃ ১৭৭- কী ধরনের উযর থাকলে মিনায় রাত্রি যাপন না করলেও গোনাহ হবে না?
উঃ- নিম্নবর্ণিত কোন এক বা একাধিক সমস্যা থাকলেঃ
(১) সম্পদ নষ্ট হওয়ার ভয় থাকলে।
(২) নিজের জানের নিরাপত্তার অভাববোধ করলে।
(৩) এমন অসুস্থতা যে অবস্থায় মিনায় রাত্রি যাপন করলে তার কষ্ট বেড়ে যেতে পারে।
(৪) অথবা এমন রোগী সাথে থাকা যার সেবা-শুশ্রুষার জন্য মিনার বাইরে থাকা প্রয়োজন।
(৫) এমন লোকের অধীনে চাকুরীরত যার নির্দেশ অমান্যে চাকুরী হারানোর ভয় আছে, এ ধরনের শরয়ী ওযর থাকলে।
প্রঃ ১৭৮- ১০, ১১ ও ১২ই যিলহজ্জ তারিখে দিনের বেলায় মিনায় থাকাও কি জরুরী?
উঃ- না, তবে থাকাটা উত্তম।
প্রঃ ১৭৯- রাতের কি পরিমাণ অংশ মিনায় কাটালে রাত্রি যাপনের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে?
উঃ- অর্ধেকের বেশী সময়।
প্রঃ ১৮০- মিনায় অবস্থানের দিনগুলোতে সালাত আদায়ের নিয়ম কি?
উঃ- চার রাক'আত বিশিষ্ট ফরজ সালাতগুলো দুই রাক'আত করে পড়বেন। তবে একত্রে জমা করবেন না। স্ব স্ব ওয়াক্তে আদায় করবেন। তবে যারা মিনাতে নিজেকে মুকীম বিবেচনা করবে তাদের ৪ রাকআত পড়ারও অবকাশ রয়েছে।
প্রঃ ১৮১:- মিনায় সাধারণতঃ কী কী সমস্যা হয়ে থাকে এবং এ থেকে সমাধানের উপায় কী?
উঃ- মিনায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পেশাব পায়খানার সমস্যা। প্রতিটি টয়লেটের সামনে ৩/৪ জনের লাইন দিবা রাত্রি সব সময়ই লেগে থাকে। খানা পিনা কম খেলে এ সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। যানজটের কারণে নিয়মিত ও সময়মত খাবার পরিবেশন সেখানে ব্যহত হয়। তখন ক্ষুধা নিয়ে কিছুটা কষ্ট করতে হয়, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। আপনার তাঁবুর নিকটে যে ক'টি খুঁটি আছে আগে থেকেই সেগুলোর নম্বর জেনে রাখুন। তাহলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় থেকে আপনি শঙ্কামুক্ত থাকতে পারবেন। মিনার একটি মানচিত্র সর্বক্ষণ সাথে রাখতে পারলে আরো ভাল হয়।
প্রণয়নে :
অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

সম্পাদনা :
ড. মোহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী
ড. শামসুল হক সিদ্দিক
মাও. আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
মুফতী সানাউল্লাহ নজির আহমদ

প্রকাশনায় : এশিয়ান ট্রাভেলস নেটওয়ার্ক লিঃ
তত্বাবধানে : তাআউন ফাউন্ডেশন-এর পক্ষে
মোঃ রফিকুল ইসলাম
সর্বস্বত্ত্ব : গ্রন্থকার কর্তৃক সংরক্ষিত

লেখক : অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম
تأليف : الأستاذ محمد نور الإسلام
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ