আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন?
আল্লাহ তাআলা আমাদের
রর ও ইলাহ। একমাত্র তিনিই ইবাদত আরাধনার উপযোগী। সে হিসেবে তিনি কোথায় সে বিষয়ে
সম্যক ধারণা অর্জন আমাদের জন্য ওয়াজিব, যাতে আমরা তাঁর প্রতি একাগ্রচিত্তে ধাবিত হতে পারি, যথার্থরূপে ইবাদত-বন্দেগি পালনে সক্ষম হই।
আল্লাহ কোথায়
আছেন? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হল তিনি আরশের উপরে আছেন। আরশের উপরে থাকা আল্লাহ
তাআলার একটি অন্যন্য সিফাত, আল কোরআন ও সহিহ হাদীসে এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে,
যেমন রয়েছে আল্লাহ তাআলার শ্রবন করা, দেখা, কথা বলা, অবতীর্ণ হওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য
সিফাতসমূহ। সালাফে সালেহীনদের আকিদা আর মুক্তিপ্রাপ্ত দল বা আহলে সুন্নত ওয়াল
জামাআত এ আকিদাই পোষণ করেন কোনোরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সৃষ্টির সাথে তুলনা
ব্যতীত। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَيْسَ
كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ﴿الشوري11﴾
তাঁর মত কিছু নেই আর তিনি সর্বশ্রোতা ও
সর্বদ্রষ্টা।(সূরা শুরা,৪২: ১১ আয়াত)
এ কারণে যখন ইমাম মালেক রহ. কে (আর-রহমান,
যিনি আরশের উপরে উঠেছেন) এ আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন
করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন: استواء তথা আরশের
উপরে ওঠার বিষয়টি জানা, কিন্তু তার ধরণ অজানা, আর এ বিষয়ের উপর ঈমান আনা ওয়াজিব।
হে মুসলিম ভাই, ইমাম মালেক রহ. এর বক্তব্যের প্রতি খেয়াল করুন। কারণ, তিনি আল্লাহ
যে উপরে আছেন, তার উপর ঈমান আনাকে প্রতিটি মুসলিমের জন্য ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু
কিভাবে আছেন, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
এ জন্যই আল্লাহ তাআলার যেসমস্ত
সিফাত কোরআন ও সহিহ হাদীসে আছে, তার কোনটাকে অস্বীকার করলে, (যেমন আল্লাহ যে আরশের
উপরে আছেন) সে ঐ আয়াত বা হাদীসকে অস্বীকারকারী হল। কারণ, এ সিফাত হচ্ছে পূর্ণতার,
সম্মানের ও সর্বশীর্ষতার। তা কোন ক্রমেই আল্লাহর ব্যাপারে অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু পরবর্তী জামানার কিছু ওলামা যারা দর্শনের (philosophy) দ্বারা প্রভাবিত,
তারা কিছু কিছু আয়াত ও সিফাতকে তাবিল বা দূরব্যাখ্যা দিয়ে ভিন্ন অর্থে নিয়ে যান।
এধরনের তাবিলের কারণে বহু লোকের আকিদা নষ্ট হয়ে যায়। তারা আল্লাহ তাআলার এই পূর্ণ
সিফাতকে পর্যন্ত অস্বীকার করে বসে। তারা সালাফগণের পথের বিরোধিতা করে। কিন্তু মূলে
সালাফগণের রাস্তাই হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য, জ্ঞাননির্ভর ও হিকমতপূর্ণ। ঐ ব্যক্তির কথা
কতোই না উত্তম যিনি বলেন: প্রতিটি ভালোই রয়েছে সালাফগণের রাস্তা অনুসরনের মধ্যে,
আর প্রতিটি খারাবীই রয়েছে পরবর্তীগণের বিদআতকে মূল কথা বলে মেনে নিয়ে তা অনুসরনের
মধ্যে।
কোরআন ও সহিহ
হাদীসে আল্লাহ তাআলার যেসমস্ত সিফাতের কথা বলা হয়েছে তার উপর ঈমান আনা ওয়াজিব। তাঁর
সিফাতসমূহের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা, অথবা তার কিছু সিফাতকে যেভাবে আছে সেভাবেই
স্বীকার করা আর কিছুকে পরিবর্তন করে বিশ্বাস করা কিছুতেই জায়েয হবে না। যে ব্যক্তি
বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা শ্রবনকারী ও দর্শনকারী, তার মানে এই নয় যে,
তার শ্রবন ও দর্শন যন্ত্র আমাদেরই মত।
তার জন্য এটাও
বিশ্বাস করা দরকার যে, আল্লাহ আসমানের উপর আছেন, তার সম্মান অনুযায়ী, কোন সৃষ্টির
সাদৃশ্য হয়ে নয়। কারণ এ সিফাতসমূহ আল্লাহ তাআলার পূর্ণতা প্রকাশ করে। তা আল্লাহ
তাআলা স্বয়ং তাঁর কিতাবে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদীসেও তা বিদৃত করেছেন। আর সত্যিকারের ফিতরতও তা স্বীকার করে,
আর সত্যিকারের বুদ্ধি বিবেচনাও তা মেন নেয়।
ইমাম বুখারীর রহ.
এর উস্তাদ নাইম ইবনে হাম্মাদ রহ. বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে
তুলনা করল সে যেন কুফরী করল। আর আল্লাহ তাআলা নিজের সম্বন্ধে যা বলেছেন তা যে ব্যক্তি
অস্বীকার করল সে যেন কুফরী করল। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সম্বন্ধে কিংবা তাঁর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্বন্ধে যা বলেছেন তাতে কোন তুলনা নেই।
(শরহে আকিদাহ্ তাহাবিয়া)।
আল্লাহ আরশের উপর আছেন
কোরআন, সহীহ
হাদীস, সৎ বুদ্ধি, সহীহ অনুভূতি সমস্ত কিছুই উপরোক্ত কথাকে সমর্থন করে।
১। আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:
الرَّحْمَنُ
عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ﴿طه5﴾
পরম করুণাময় আরশের
উপর আছেন।(সূরা তাহা, ২০: ৫ আয়াত।)
২। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَأَمِنْتُمْ
مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْض(الملك 16)
তোমরা তার থেকে
নির্ভয় হয়ে গেলে যিনি আসমানে আছেন, আর তিনি তোমাদের সহকারে জমিনকে ধ্বসিয়ে দিবেন
না?।(সূরা মূলক ৬৭: ১৬ আয়াত)।
ইবনে আব্বাস রা. এই আয়াতের তাফসীরে বলেন: তিনি
হলেন আল্লাহ। (তাফসীরে ইবনুল জাওযি)।
৩। আল্লাহ তাআলা
আরও বলেন:
يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ(النحل50)
তারা তাদের উপরস্থ
রবকে ভয় করে। (সূরা নাহল,১৬: ৫০ আয়াত)।
৪। আল্লাহ তাআলা
ইসা আ. সম্বন্ধে বলেন:
بَلْ
رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ(النساء 158)
বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকটে উত্তলন করে নিয়েছেন।
(সূরা নিসা, ৪: ১৫৮ আয়াত)।
৫। তিনি আরও বলেন:
وَهُوَ
اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ(الأنعام3)
আর তিনিই আল্লাহ
যিনি আসমানে আছেন। (সূরা আনআম ৬: ৩ আয়াত)।
এ সমস্ত আয়াতের
তাফসীরে ইবনে কাসীর রহ: বলেন: তাফসীরকারকগণ এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, “তারা
আল্লাহ সম্বন্ধে ঐভাবে বর্ণনা করবেন না যেভাবে জাহমীয়ারা (একটি ভ্রষ্ট দল) বলে যে,
আল্লাহ সর্বত্র আছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের এ জাতীয় কথা হতে পাক পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। ”
আল্লাহ তাআলার
বাণী:
وَهُوَ
مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ(الحديد 4)
তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা হাদীদ, ৫৭: ৪
আয়াত)।
অত্র আয়াতের ব্যখ্যা হল; নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা,
শ্রবনের দ্বারা, যা বর্ণিত আছে তফসীরে জালালাইন ও ইবনে কাসীরে। এই আয়াতের পূর্বের
ও শেষের অংশ এ কথারই ব্যখ্যা প্রদান করে।
৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সপ্তম আসমানের উপর উঠানো হয়েছিল,
তাঁর রবের সাথে কথোপকথনের জন্য। আর সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল।
(বুখারী ও মুসলিম)।
৭। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
ألاَ تأمَنُونيِْْ وَأنا أمِينُ مَنْ فيِ السَّمَاء (وهو اللهُ) (ومعني
في السَّماء: علي السَّمَاء) (متفق عليه)
তোমরা কি আমাকে
আমিন (বিশ্বাসী) বলে স্বীকার কর না? আমি তো ঐ সত্ত্বার নিকট আমিন বলে পরিগণিত যিনি
আসমানের উপর আছেন। (আর তিনি হলেন আল্লাহ)। (বুখারী ও মুসলিম)।
৮। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء (أي هو الله) (الترمذي وقال حسن صحيح)
যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া কর, তবেই যিনি
আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।
(তিরমিযী হাসান সহীহ)।
৯। অন্য হাদীসে
এসেছে:
سأَلَ رَسُولُ الله صلي الله عليه وسلَّمَ جَارِيَةً فَقَالَ لَهَا: أيْنَ
اللهَ؟ فَقَالَتْ في السَّماءِ قَالَ مَنْ أنا؟ قَالَتْ أنْتَ رَسٌولُ اللهِ
قَالَ: أعْتِقْهَا فإنَّها مُؤْمِنَةً . (مسلم)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাসীকে
জিজ্ঞেস করলেন: বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তারপর তিনি বললেন: বলতো আমি কে?
সে বলল: আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা।
(মুসলিম)।
১০। অন্যত্র রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
وَالْعَرْشُ فَوْقَ الْمَاء وَاللهُ فَوْقَ عَرْشِهِ وَهُوَ يَعْلَمُ
مَا انتُمْ عَلَيْهِ. (حسن رواه أبو داود)
আরশ পানির উপর আর
আল্লাহ আরশের উপর। তৎসত্তেও,
তোমরা কি কর বা না কর তিনি তা জ্ঞাত আছেন। (আবু দাউদ হাসান)।
১১। আবু বকর রা. বলেছেন:
ومَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فإنَّ اللهَ فيِ السماء حَيٌّ لا يمُوتُ
(رواه الدارمي في الرد غلي الجهمية باسناد صحيح)
যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমানের
উপর জীবিত আছেন, কখনোই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন না। (সুনানে দারেমী সহীহ সনদ)
জাহমীয়াদের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
১২। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমরা কিভাবে আমাদের রব
সম্বন্ধে জানতে পারব? উত্তরে তিনি বলেছেন: তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে
আলাদা হয়ে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের জাত আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে। তার
এই উপরে থাকা সৃষ্টির সাথে কোন সামঞ্জস্য নেই।
১৩। চার ইমামগণই এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোন
সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।
১৪। মুসল্লী সিজদায় বলেন: (আমরা মহান উঁচু রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি)। দোয়া
করার সময় সে তার হস্তদয়কে আসমানের দিকে উত্তলন করে।
১৫। যখন বাচ্চাদের প্রশ্ন করা হয়, বলত আল্লাহ কেথায়? তখন তারা তাদের স্বভাবজাত
প্রবৃত্তির বশে বলে: তিনি আসমানে।
১৬। সুস্থ বুদ্ধি, বিবেক, আল্লাহ যে আসমানে আছেন তা সমর্থন করে। যদি তিনি
সর্বত্রই বিরাজমান হতেন তবে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতেন এবং সাহাবীদের
শিক্ষা দিতেন। দুনিয়ার বুকে এমন অনেক নাপাক অপবিত্র জায়গা আছে যেখানে তাঁর থাকার
প্রশ্নই উঠে না।
১৭। যদি বলা হয়, আল্লাহ তাআলা তার জাত সহকারে আমাদের সাথে সর্বস্থানে আছেন,
তবে তার জাতকে বিভক্ত করতে হয়। কারণ, সর্বত্র বলতে বহু জায়গা বুঝায়। এটাই ঠিক যে
আল্লাহ তাআলার পবিত্র জাত এক ও অভিন্ন। তাকে কোন অবস্থাতেই বিভক্ত করা যায় না। তাই
ঐ কথার কোন মূল্য নেই, যে তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আর এটা প্রমাণিত যে, তিনি আসমানে
আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তাঁর শ্রবেনর, দেখার ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে
সম্যক অবহিত ।
সমাপ্ত
লেখক: আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান
সম্পাদনা: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
0 মন্তব্যসমূহ