কোনো এক স্থানের চাঁদ দেখা সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য কি?



কোনো এক স্থানের চাঁদ দেখা সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য কি?

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস্ স্বালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল্ আমীন, আম্মা বাদঃ
অতঃপর পবিত্র রামাযান মাস এবং ঈদ নিকটে আসলেই মুসলিম সমাজে একটি বিষয়ের চর্চা বৃদ্ধি পায়; বরং সাম্প্রতি বিষয়টির চর্চা একটু বেশীই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তা হল, পৃথিবীর কোনো স্থানে বা দেশে যদি হিলাল (১ম তারিখের চাঁদ) দেখা যায় এবং সেই সংবাদ যদি বিভিন্ন দেশে পৌঁছে যায়, তাহলে সেই খবরটি সকল মুসলিমের সাউম শুরু করা বা ছাড়ার জন্য প্রযোজ্য কি না? অনেক স্থানে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। পক্ষে বিপক্ষে দলীল-প্রমাণ ও যুক্তি দিতেও দেখা যায়। আবার অনেকে এসবের তোয়াক্কা না করে অন্য দেশে চাঁদ দেখা দিলে বিশেষ করে সউদীতে দেখা দিলে তারা সউদীর সাথে সাউম পালন শুরু করে দেয় কিংবা ঈদ করে। এর ফলে একই দেশে ও সমাজে বসবাস করার পরেও কেউ এক-দুই দিন আগেই রোযা ধরে কিংবা ছাড়ে।


আর বিষয়টি এখন শুধু এই তর্কে সীমিত নেই যে, অন্য দেশে চাঁদ দেখা দিলে আমাদের জন্যও তা প্রযো‍জ্য না অপ্রযোজ্য বরং তা একধাপ এগিয়ে এই তর্কে পৌঁছেছে যে, সেই সংবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর সকল মুসলিমের প্রতি সাউম শুরু করা বা ছাড়া জরূরি কি না? বলতে পারেন এর থেকেও এক ধাপ এগিয়ে এখন এই তর্কে পৌঁছেছে যে, যারা এই সংবাদ পাওয়ার পরেও রোযা করে না বা ঈদ করে না, তাদের নাকি সাউম ও ঈদ হয় না, তারা নাকি বড় গুনাহগার, বিদআতী এমন কি তাদের মুসলমানিত্বেও এখন প্রশ্ন! 

এই সময় কিছু নাম কে ওয়াস্তে মুসলিম এবং মডার্যাুট মুসলিমদেরও ইসলামের কথা বলতে শোনা যায়। তারা যেহেতু এক সাথে সীমাই খেতে পারে না, একই দিনে আনন্দ শেয়ার করতে পারে না, তাই উলামাদের লক্ষ্য করে বলেঃ এদের কারণে মুসলিম সমাজে ঐক্য আসে না, এদের কারণে মুসলিমরা এক হতে পারে না, এদের কারণেই মুসলিমদের এই দুরাবস্থা। এরা অন্যান্য বিষয়ে তো মতভেদ করেই কিন্তু ঈদের মত বড় বিষয়েও মতভেদ করতে ছাড়ে না। এদের কারণেই আমরা ঈদের মত একটি বড় পর্বকে একই দিনে পালন করতে পারছি না, এক সাথে আনন্দ শেয়ার করতে পারছি না। বিশ্বের অমুসলিমরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে আর হাসছে। বড়ই পরিতাপের বিষয়!  অতঃপর শুরু হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাসের শুরু ও শেষ হওয়ার হিসেব নিকেশ।

আমরা বক্ষ্যমান লেখাতে উক্ত বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে শরীয়ার দলীল প্রমাণ এবং সালাফে সালেহীন ও উলামাগণের মন্তব্য পেশ করবো, অতঃপর সেই আলোকে একটি সমাধানে আসতে সচেষ্ট হব, ইন শাআল্লাহ। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।

মতভেদের কারণঃ

বিশ্বের কোনো দেশে বা প্রান্তে হিলাল দেখা দিলে এবং সেই সংবাদ বাকী দেশে ও প্রান্তে পৌঁছে গেলে, সেই সংবাদের ভিত্তিতে সকল মুসলিমের এক সাথে সাউম শুরু করা বা না করা এবং ঈদ করা বা না করার বিষয়ে যেই মতভেদ বিদ্যমান তার মুখ্য কারণ হচ্ছে দুটি: 
(ক) দলীল-প্রমাণে উভয় মতের অবকাশ থাকা। 
(খ) এই বাস্তবতা যে, পৃথিবীর সব স্থানে একই সময়ে চাঁদ প্রকাশ না পাওয়া।

যদি কোনো দেশবাসী রামাযান মাসের হিলাল দেখে, তাহলে তাদের দেখার ভিত্তিতে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত দেশবাসীর প্রতি সাউম পালন করা জরূরী হয়ে যায়, না উদয়স্থলের তারতম্যের কারণে প্রত্যেক দেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র দর্শনের ভিত্তিতে তাদের উপর রোযা পালন করা ও ঈদ করা জরূরী হবে? এ বিষয়ে বিগত উলামাগণের দুটি মৌলিক মত পাওয়া যায়।

প্রথম মতঃ 

চন্দ্রের উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে এক দেশের চাঁদ দেখা পৃথিবীর সকল দেশের জন্য যথেষ্ট হবে না; বরং প্রত্যেক দেশের জন্য স্বতন্ত্র দর্শন স্বীকৃত হবে। এই মতটি ইকরামা, কাসেম, সালেম, ইসহাক্ব সহ ইমাম শাফেয়ী ব্যক্ত করেছেন। [ফিকহ বিশ্বকোষ ২২/৩৬, আল্ মাজমূ ৫/২৭৩-২৭৫, আল্ মুগনী ৪/৩২৮]

এই মতের একটু ব্যাখ্যা স্বরূপ ইমাম নবভী বলেনঃ এই দর্শন সকল মানুষের জন্য সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য হবে না; বরং যতখানি দূরত্বে নামায কসর করা বৈধ নয়, ততদূর পর্যন্ত স্বীকৃত হবে। আরোও বলা হয়েছে, যদি চন্দ্রের উদয়স্থল এক হয় তাহলে তাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে। [শারহু মুসলিম ৪/২০৯]

এই মতের দলীলাদিঃ  

১ম দলীলঃ কুরাইব থেবে বর্ণিত যে, উম্মুল ফায্ল তাকে সিরিয়া প্রদেশে মুআবীয়ার নিকট প্রেরণ করেন। তিনি বলেনঃ “আমি সিরিয়ায় আসলাম এবং তার প্রয়োজন পূরণ করলাম। এই সময় রামাযান শুরু হল আর আমি শুক্রবারের রাতে চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষে মদীনায় ফেরত আসলাম। তখন হিলালের প্রসঙ্গ উঠলেআব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাযিঃ) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমরা হিলাল কখন দেখেছো? আমি বললামঃ জুমআর রাতে। তিনি বললেনঃ তুমি দেখেছিলে? আমি বললামঃ হাঁ এবং অন্য লোকেরাও দেখেছিল। তারা সকলে রোযা রেখেছে এবং মুআবীয়াও রোযা রাখেন। তখন তিনি (ইবনে আব্বাস রাযিঃ) বললেনঃ কিন্তু আমরা তো শনিবারের রাতে চাঁদ দেখেছি। তাই আমরা সাউম রাখবো যতক্ষণে ৩০ পূরণ না হয় কিংবা তা না দেখতে পাই। আমি তাকে বললামঃ আমাদের জন্য মুআবিয়ার দর্শন ও তার রোযা করা যথেষ্ট নয় কি? তিনি বললেনঃ না। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই আদেশ করেছেন।” [মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়, অনুচ্ছেদ নং ৫ হাদীস নং (১০৮৭]

প্রমাণকরণঃ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) শামবাসীদের হিলাল দর্শন মদীনাবাসীদের জন্য যথেষ্ট মনে করলেন না, যা দ্বারা বুঝা যায় এক দেশের হিলাল দর্শন অন্য দেশবাসীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আপত্তিঃ এটি ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর ব্যক্তিগত রায় তথা ইজতিহাদ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস নয়।

আপত্তির উত্তরঃ

(ক) কোনো সাহাবীর উক্তি যে, ‘আল্লাহর রাসূল আমাদের আদেশ করেছেন’ কিংবা‘আমাদের আদেশ করা হয়েছে’ বা ‘আমাদের নিষেধ করা হয়েছে’বা ‘আদেশ করা হত’ বা নিষেধ করা হত’ এমন বাক্য উসূলে হাদীসের নীতিতে এবং হাদীসের পন্ডিতদের নিকট মারফু ও মুসনাদ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত । [উলূমুল হাদীস, ইবনু সালাহ, পৃঃ ৪৯, দারুল ফিকর বৈরূতের ছাপা] তাই ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর উপরোক্ত হাদীস (আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই আদেশ করেছেন) একটি মারফূ ও মুসনাদ হাদীস তাঁর ইজতিহাদ বা নিজস্ব রায় নয়।

(খ) উসূলে ফিকহের নীতিতে উল্লেখ হয়েছে, সাহাবীর কথা যদি তার বিরোধিতা না করা হয়, তাহলে তা গ্রহণীয়। এই নিয়মেও ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর এই হাদীস গৃহীত ও আমল যোগ্য কারণ তাঁর কথার বিরোধিতা অন্য সাহাবাগণ করেন নি।

(গ) যারা এমন মন্তব্য করেন যে, এটা ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) এর ইজতেহাদ বা তাঁর ইজতেহাদ গ্রহণ করাটা আমাদের জন্য জরূরী নয়। তাঁদের চিন্তা করা উচিৎ যে, নবী (সাঃ) এর পর এমন একটি বড় বিষয়ে নবীজীর দুআপ্রাপ্ত সম্মানিত সাহাবী যাঁকে (হাবরুল উম্মাহ) ও (তুরজুমানুল কুরআন) উম্মতের পন্ডিত ও কুরআনের মুফাস্সির উপাধী দেওয়া হয়েছে, তাঁর ইজতিহাদ গ্রহণ না করা হলে এ যুগের কার ইজতেহাদ গ্রহণীয় হবে?!

২য় দলীলঃ আল্লাহর বাণীঃ  
( فَمَنْ شَهِدَ منكم الشّهْرَ فَلْيَصُمْهُ )
অর্থঃ (কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা পালন করে) [বাকারাহ/১৮৫]

এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ 
صوموا لرؤيته و أفطروا لرؤيته فإن غُبِّيَ عليكم فأكملوا عدّة شعبان ثلاثين.
অর্থঃ “তোমরা তা (চাঁদ) দেখে রোযা রাখ এবং তা দেখে রোযা ছাড়, যদি মেঘাচ্ছন্নের কারণে না দেখতে পাও, তাহলে শা’বান মাস ৩০ পূরণ করে নাও”। [বুখারী, সাউম অধ্যায়, নং ১৯০৯, মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়]

প্রমাণকরণঃ উপরোক্ত কুরআনের আয়াতেসাউম রাখার আদেশ রামাযান মাস পাওয়ার সাথে এবং হাদীসে সাউম রাখার আদেশ চাঁদ দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, যাদের নিকট সেই মাস এখনও উপস্থিত হয় নি বা তারা চাঁদ দেখতে পায় নি, তাদের জন্য এই আদেশ প্রযোজ্য হয় নি। তাই চন্দ্র উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে ঐ দেশবাসী যাদের দেশে এখনও চাঁদ উঠেনি তাদের অবস্থা এমন যে, তারা না তো হিলাল দেখেছে আর না তাদের নিকট রামাযান মাস উপস্থিত হয়েছে, ফলে এই বিধান তাদের জন্য প্রযোজ্যও হবে না।

আপত্তিঃ যদিও তারা হিলাল দেখতে পায় নি কিন্তু অন্য সৎ মুসলিম ভাই তো দেখেছে এবং দর্শনকারীর সংবাদ তো তার কাছে পৌঁছেছে। নবী (সাঃ) অন্য সৎ মুসলিম ব্যক্তির চাঁদ দেখার সংবাদের কারণে নিজে রোযা রেখেছেন এবং সাহাবীদেরও রোযা পালনের আদেশ দিয়েছেন। ইবনে উমার (রাযিঃ) বলেনঃ “ লোকেরা হিলাল দেখা-দেখি করে, তারপর আমি রাসূল (সাঃ) কে সংবাদ দিলাম যে, আমি হিলাল দেখেছি। তাই তিনি (সাঃ) রোযা রাখেন এবং লোকদের রোযা রাখার আদেশ দেন”। [আবু দাঊদ, ২৩৪০/ইবনু হিব্বান ৩৪৪৭]

উত্তরঃ সাহাবী ইবনে উমার (রাযিঃ) কোনো এমন দেশ থেকে এসে এই সংবাদ দেন নি যে, সেই দেশে চাঁদ দেখা গিয়েছিল আর মদীনায় যায়নি। আর নবী (সাঃ) তার সেই অন্য দেশের দর্শনকে মদীনাবাসীর জন্য প্রযোজ্য মনে করেছিলেন; বরং সাহাবী ইবনে উমার মদীনা শহরের অধিবাসী ছিলেন এবং মদীনাবাসী নবী (সাঃ) কে সংবাদ দিয়েছিলেন।এমন সংবাদ গ্রহণে আপত্তি নেই কারণ এটা এক দেশ বরং একই শহরের সংবাদ, যাতে চন্দ্রের উদয়স্থল এক। আর আমাদের বিষয় হচ্ছে একটি ভিন্ন দেশের সংবাদ যেখানকার চন্দ্রের উদয়স্থল বর্তমান দেশের উদয়স্থল থেকে ভিন্ন। বেদুইনের সংবাদে রোযা শুরু করা ও কাফেলার সংবাদে ঈদ করার হাদীসের জন্যও এই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য; কারণ অন্য স্থান থেকে তাদের আগমন কোনো বড় দূরত্ব বুঝায় না।

৩য় দলীলঃ (বিবেক ও বাস্তবতা)

দেশের দূরত্বের কারণে যেমন সূর্যের উঠা ডুবাতে পার্থক্য রয়েছে, তেমন চন্দ্রের উদয় ও স্থিমিত হওয়াতে ও পার্থক্য স্বাভাবিক। তাই পূর্ব দিকের কোনো দেশে যখন ফজর হয়, তখন পশ্চিম দিকের দেশগুলিতে সেই সময় ফজর হয় না। এই ভাবে যখন ধরুন ভারত উপমহাদেশে সূর্য অস্ত যায়, তখন মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত যায় না। তাই ঐসময় ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের উপর ইফত্বার করা বৈধ হয় এবং মাগরিবের সময় হয় কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের জন্য ইফত্বার জায়েয নয় আর না তাদের ওখানে মাগরিব হয়। তাই মুসলিমদের মাঝে যেমন দৈনন্দিন রোযা শুরু করা ও ইফত্বার করার মধ্যে ব্যবধান রয়েছে, তেমন অবশ্যই মাস শেষে ইফত্বার করা তথা চন্দ্র দর্শনের ব্যাপারে ও ব্যাবধান স্বাভাবিক। আর এই রকম হলে এক সাথে রোযা শুরু করা, ছাড়া এবং ঈদ করা অসম্ভব ও বাস্তবতা বিরোধী।

• বিগত মুহাদ্দেসগণের জ্ঞানও এ মতের পক্ষেঃ

এক দেশের চাঁদ দর্শন অন্য দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, যদি চন্দ্রের উদয় স্থল ভিন্ন হয়। এই মর্মে আমরা যদি মুহাদ্দিসগণের হাদীসের অনুচ্ছেদ তথা শিরোনামগুলির দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে তাঁদের মতামত সম্বন্ধে সহজে অনুমান করেতে পারি। এ সম্পর্কে ইমাম মুসলিম (রাহ) এর অনুচ্ছেদ শিরোনাম হচ্ছে, (এই বিষয়ের বর্ণনা যে, প্রত্যেক দেশের জন্য তাদের দর্শন গৃহীত, তারা যখন কোনো দেশে হিলাল দেখবে, তখন তাদের থেকে দূরবর্তীদের জন্য সেই হিলালের বিধান প্রমাণিত হবে না)। ইমাম ইবনু খুযায়মা (রহ) এর অনুচ্ছেদ শিরোনাম হচ্ছে, (অনুচ্ছেদঃ এ কথার দলীল যে, প্রত্যেক দেশবাসীর উপর তাদের দর্শন অনুযায়ী রোযা করা জরূরী হবে, অন্যের দর্শনে নয়।) ইমাম তিরমিযী কর্তৃক লিখিত শিরোনাম হচ্ছে, (অনুচ্ছেদঃ এ কথার বর্ণনা যে, প্রত্যেক দেশের জন্য তাদের নিজেদের দর্শন রয়েছে )। অতঃপর তাঁরা ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) এর হাদীস উল্লেখ করেছেন।

ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীস বর্ণনা করার পর বলেনঃ (আহলে ইলমদের) জ্ঞানীদের এই হাদীসের প্রতি আমল রয়েছে যে, প্রত্যেক দেশবাসীর জন্য তাদের নিজের দর্শন গৃহীত।[সাউম অধ্যায়, নং ৬৮৯] সাধারনতঃ ইমাম তিরমিযী আহলে ইলমদের এমন উক্তি নকল করার সময় যদি তাদের মাঝে মতভেদ থাকে, তাহলে তিনি তাদের মতভেদও বর্ণনা করে দেন কিন্তু এই স্থলে তিনি কোনো মতভেদের দিকে ইঙ্গীত করেন নি, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, হয়তো তাঁর যুগে এ বিষয়ে তেমন মতভেদ ছিল না।

দ্বিতীয় মতঃ 

যদি কোনো এক দেশবাসী চাঁদ দেখে তো পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমদেশবাসীর প্রতি সাউম শুরু করা জরূরী হবে [এই ভাবে ঈদ করাও জরূরী হবে। কোনো দেশীয় কিংবা ভৌগলিক পার্থক্য করা যাবে না]।

এই মতটি, হানাফী, মালেকী, হাম্বালী তথা জমহূর উলামার মত। তবে মালেকী মাযহাবের উলামাদের মতামতের কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র বলেনঃ তারা এক মত পোষণ করেছেন যে, যদি দুটি দেশের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশী হয়, যেমন উন্দুলুস (স্পেন) এবং খুরাসানের (ইরান) মাঝে দূরত্ব, তাহলে সেই দর্শন এক অপরের জন্য প্রযোজ্য হবে না। [আল্ ইস্তিযকার, ইবনু আব্দিল বার্র ১০/৩০] ইবনুল মাজেশূন বলেনঃ যেই দেশে চাঁদ দেখা গেছে, তা অপর দেশের জন্য জরূরী হবে না; যতক্ষণে সেই দেসের শাসক জনগণকে আদেশ না করেন। [ইস্তিযকার ১০/২৯]

এই মতের প্রমাণসমূহঃ

১ম প্রমাণঃ আল্লাহর বাণীঃ  
( فَمَنْ شَهِدَ منكم الشّهْرَ فَلْيَصُمْهُ )
অর্থঃ (কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা পালন করে) [বাকারাহ/১৮৫]

প্রমাণ করণঃ (তোমাদের মধ্যে) সম্বোধনটি একটি ব্যাপক সম্বোধন, যা পৃথিবীর সকল লোক ও দেশের জন্য প্রযোজ্য। তাই তা কোনো  স্থান ও দেশের জন্য নির্দিষ্ট হবে না।

২য় প্রমাণঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ  
صوموا لرؤيته و أفطروا لرؤيته فإن غُبِّيَ عليكم فأكملوا عدّة شعبان ثلاثين.
অর্থঃ “তোমরা তা (চাঁদ) দেখে রোযা রাখ এবং তা দেখে রোযা ছাড়, যদি মেঘাচ্ছন্নের কারণে না দেখতে পাও, তাহলে শা’বান মাস ৩০ পূরণ করে নাও”। [বুখারী, সাউম অধ্যায়, নং ১৯০৯, মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়]

প্রমাণকরণঃ (তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং তা দেখে রোযা ছাড়) এখানে তোমরা সম্বোধনটি সকল মুসলিমদের উদ্দেশ্যে, তাই এই আদেশে পৃথিবীর সকল দেশের মুসলিম অন্তর্ভুক্ত। আর এমন হলে পৃথিবীর কোনো এক দেশের লোকদের চাঁদ দেখা বাকী সকল দেশের জন্য জরূরী হবে।

আপত্তি সমূহঃ

(ক) আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূলের এই আদেশটি ও সম্বোধনটি সকল মুসলিমের উদ্দেশ্যে ব্যাপক হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা একই সময়ে পৃথিবীর সকল দেশের মুসলিমদের জন্য বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। কারণ ইসলামের ঐ সকল বিধান যা সূর্য বা চন্দ্রের উঠা-ডুবা তথা মধ্যাকাশে হওয়ার সাথে সম্পর্ক রয়েছে তা প্রত্যেক দেশ ও স্থান অনুযায়ী উঠা-ডুবার সাথে সম্পর্কিত। এক দেশের চন্দ্র-সূর্য উদয় ও স্তিমিত হওয়া অন্য দেশের জন্য উদয় ও স্তিমিত হওয়া বুঝায় না। উদাহারণ স্বরূপ নবী (সাঃ) বলেনঃ ... “এবং সূর্য ডুবে যাবে তখন রোযাদার ইফত্বার করবে”। [বুখারী, সাউম অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ রোযাদারের জন্য কখন ইফত্বার বৈধ?/মুসলিম সিয়াম অধ্যায়] এখন নবী (সাঃ) এর এই আদেশটি ব্যাপক হলেও, তা পৃথিবীর সকল দেশের মুসলিমের জন্য একই সময়ে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব বরং অবৈধ। কারণ ধরুন ভারত উপমহাদেশে যখন সূর্য অস্ত যায় তখন তাদের ইফত্বার করা বৈধ হয় কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যবাসীদের জন্য বৈধ হয় না বরং তাদের ইফত্বার করা হারাম কারণ এখনও তাদের ওখানে সূর্য অস্ত যায় নি; অথচ আদেশটি ভারত উপমহাদেশ সহ সারা জগতের জন্য আম ও ব্যাপক। তাই চাঁদ দেখে রোযা ধর ও ছাড় আদেশটি ব্যাপক হলেও একই সময়ে সকল দেশের জন্য আমল করা অসম্ভব ও অবাস্তব। কারণ সূর্যের ন্যায় চন্দ্রের উদয় ও স্তিমিত হওয়াতে পার্থক্য থাকা বাস্তব ও প্রমাণিত এবং যেভাবে দৈনন্দিন সময়-সুচী প্রত্যেক দেশ অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয়, সেভাবে মাসিক সময়-সুচীও দেশ অনুযায়ী বাস্তবায়িত হবে।

(খ) উপরোক্ত কিতাব ও সুন্নার আদেশটি আমরা যারা সাধারণ ভাবে আম-ব্যাপক বুঝে তা পৃথিবীর সকল মুসলিমের জন্য পালন করা জরূরী মনে করছি, সালাফ ও খুলাফায়ে রাশেদীনগণ তেমন বুঝেন নি। তাই খলীফাদের যুগে ইসলাম যখন আরব উপদ্বীপ পেরিয়ে বহূ দুরে পৌঁছেছিল, তখন কোনো খলীফা তাঁর খেলাফতের সকল বাসিন্দাদের একই সাথে রোযা শুরু করতে হবে বা তাদের সকলকেএক সাথে ঈদ করতে হবে বলে মনে করতেন না। এই কারণে কোনো খলীফার এমন নিয়ম ছিল না যে, যখন তাঁর শহরে রোযার চাঁদ কিংবা ঈদের চাঁদ দেখা দিত, তখন তিনি বিশেষ দূত তাঁর খেলাফতের সকল দূরবর্তী স্থানে প্রেরণ করে এই সংবাদের ব্যবস্থা করতেন।

ইমাম সুবক্বী তাঁর স্বীয় গ্রন্থ “আল্ ইলম আল্ মানশূর ফী ইসবাতিশ্ শহূর” পৃঃ ১৫ তে উল্লেখ করেনঃ [... কারণ উমার বিন খাত্তাব এবং সমস্ত খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে এটা বর্ণিত নেই যে, তারা যখন হিলাল দেখতেন, তখন দূরবর্তী প্রদেশে পত্র লিখতেন। যদি উপরোক্ত বিধান তাদের উপর জরূরী হত, তাহলে তাঁরা তাদের অবশ্যই লিখতেন; কারণ তাঁরা দ্বীনের বিষয়ে যত্নশীল ছিলেন ......]

৩য় প্রমাণঃ ইবনে উমার (রাযিঃ) বলেনঃ “ লোকেরা হিলাল দেখা-দেখি করে, তারপর আমি রাসূল (সাঃ) কে সংবাদ দিলাম যে, আমি হিলাল দেখেছি। তাই তিনি (সাঃ) রোযা রাখেন এবং লোকদের রোযা রাখার আদেশ দেন”। [আবু দাঊদ, সিয়াম অধ্যায় নং ২৩৪২/ইবনু হিব্বান ৩৪৪৭]

একদা এক আ’রাবী (বেদুইন) নবী (সাঃ) কে সংবাদ দেয় যে, সে হিলাল দেখেছে, তখন রাসূল (সাঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি কি সাক্ষী দিচ্ছ যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই এবং অবশ্যই মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল”? সে বললঃ হাঁ। তারপর নবীজী বিলালকে বললেনঃ “বিলাল উঠ এবং লোকদের সংবাদ দিয়ে দাও যেন তারা আগামী কাল রোযা রাখে”। [আবু দাঊদ, সিয়াম অধ্যায়, নং (২২৪০) তিরমিযী, সিয়াম অধ্যায়ঃ নং (৬৯১) নাসাঈ, ইবনু মাজাহ]

প্রমাণকরণঃ উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ে নবী (সাঃ) মাত্র এক সৎ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সংবাদ শুনে নিজে সাউম পালন করেন এবং অন্যদের সাউম পালনের আদেশ দেন, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, যদি আমাদের নিকটও সৎ লোকের মাধ্যমে চাঁদের সংবাদ পৌঁছে যায়, তাহলে সকলের প্রতি রোযা শুরু করা জরূরী হবে; সংবাদটি যেই দেশেরই হোক না কেন। এই ভাবে ঈদ পালনের ক্ষেত্রেও।

আপত্তি সমূহঃ

(ক) উপরোক্ত হাদীস দুটির মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ এবং উলামাগণ যা বুঝেছেন বা যা প্রমাণ করেছেন, তা হলঃ এক জন সৎ ব্যক্তির চাঁদ দেখার সাক্ষীর উপর নির্ভর করে সাউম শুরু করা বৈধ। এমন নয় যে, এক জন এমন দূর দেশের লোকের সাক্ষী যার দেশের চন্দ্রস্থল বর্তমান দেশ থেকে ভিন্ন, তার পরেও নবী (সাঃ) তার সাক্ষী রোযা পালনে গ্রহণ করেছেন।

(খ) আমাদের বিষয়বস্তু হচ্ছে, এমন দেশের চাঁদ দর্শনের সংবাদ বাকী দেশগুলির জন্য জরূরী কি না, যেই দেশের চন্দ্র উদয়স্থল বাকী দেশের চন্দ্র উদয়স্থল থেকে ভিন্ন। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ে হিলাল দেখার সংবাদদাতা এবং সংবাদ গ্রহীতা একই দেশের বরং একই শহরের, যাদের চন্দ্রের উদয় সময়ে পার্থক্য ছিল না। তাই হাদীস দুটি আমাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।

(গ) তার পরেও আমরা যদি উভয় হাদীসকে আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত মনে করি, তাহলে মনে রাখা উচিৎ যে সেই সংবাদটি দেশের ইমাম (শাসক) অর্থাৎ নবী (সাঃ) গ্রহণ করেন অতঃপর সকল লোকদের তা গ্রহণ করার আদেশ করেন। বুঝা যাচ্ছে, সেই সংবাদটি সাধারণ লোকেরা নিজে নিজে গ্রহণ করে স্বয়ং আমল শুরু করেননি; বরং ইমাম তা সত্যায়িত করেছেন এবং তিনি তাঁর জনগণকে ফরমান জারি করে তা গ্রহণ করার আদেশ জারি করেছেন। আর এই রকম নিয়মে যদি এখনও কোনো দেশের শাসক অন্য দেশের সংবাদের যাঁচাই করে নিজ দেশের জন্য গ্রহণীয় মনে করে সারা দেশের লোকদের সাউম পালন বা ঈদ করতে আদেশ করেন, তাহলে তা গ্রহণে কোনো আপত্তি হতে পারে না। কিন্তু যদি এমন না হয়, তাহলে চন্দ্র উদয় সময়ে পার্থক্য রয়েছে, এমন দেশের সংবাদকে যদি ভিন্ন দেশের সাধারণ জনগণ নিজ ইচ্ছায় নিজের মত করে কেউ মেনে নিয়ে সাউম পালন করে কিংবা রোযা ছাড়ে, তাহলে যেমন নববী তরীকার বরখেলাফ করা হয়, তেমন হাদীসেরও বিপরীত আমল করা হয়, যাতে নবী (সাঃ) তাঁর উম্মতকে এক সাথে রোযা রাখার বা ঈদ করার আদেশ করেছেন। নবী (সাঃ) বলেনঃ “সাউম সেদিন যেদিন তোমরা সকলে রোযা রাখ, আর ঈদ সেদিন, যেদিন তোমরা সকলে ঈদ কর, আর কুরবানী সেদিন যেদিন তোমরা সকলে কুরবানী কর”। [তিরমিযী, আবু দাঊদ, বায়হাক্বী, সহীহ সুনান তিরমিযী ১/২১৩]

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ কতিপয় জ্ঞানী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ এর অর্থ, রোযা এবং ঈদ জামাআত ও সংখ্যাগুরুর সাথে হবে”।

আয়েশা (রাযিঃ) বলেনঃ কুরবানী সেদিন যেদিন সকল লোক কুরবানী করে আর ঈদ সেদিন যেদিন সকল লোক ঈদ করে”। [তিরমিযী, সিলসিলা সহীহা নং (২২৪)]

উল্লেখ্য যে, রামাযানের রোযা শুরু করা এবং ঈদ পালন করা একটি সম্মিলিতাকারে পালন করার ইবাদত বিচ্ছিন্নরূপে পালন করার নয়। তাই এক দেশে বা এক অঞ্চলে বা এক শহরে ও গ্রামে বসবাসকারী লোকেরা বিচ্ছিন্নরূপে কেউ আজ আর কেউ কাল রোযা রাখতে পারে না আর না ঈদ করতে পারে। আর এমন হলে আমরা কমপক্ষে একটি দেশীয় ঐক্য রক্ষা করতে সক্ষম হতে পারি। অন্যথায় এই সময়উপরোক্ত মতের দলীলগুলি সরাসরি আমল করতে লাগলে বিশ্ব ঐক্য তো দূরের কথা বরং একটি দেশীয় ঐক্য বরং একটি প্রাদেশিক ঐক্য বরং একটি শহরবাসীর  ঐক্য এমন কি একটি বাড়ির ঐক্য স্থাপন করাও দূরুহ হয়ে দাঁড়াবে, যেমন আমরা উপরোক্ত হাদীসের আলোকে দূর দেশের সংবাদ শুনেই সরাসরি রোযা পালনকারীদের মাঝে এই সব মতভেদ লক্ষ্য করছি।

৪র্থ প্রমাণঃ (একটি যুক্তি) এক সাথে রোযা শুরু করা ও ঈদ করাতে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

আপত্তি সমূহঃ

প্রথমতঃ এটি একটি যুক্তি ও অনুমান মাত্র, তা হতেও পারে আর নাও পারে।

দ্বিতীয়তঃ প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম ঐক্য বলতে কি বুঝায় এবং মুসলিম ঐক্য কিসে হতে হবে? সত্যিকারে মুসলিম ঐক্য বলতে বুঝায় তাওহীদের প্রতি ঐক্য। আর ঐক্য হবে ইসলামের মৌলিক ও সার্বিক বিষয় সমূহে; অথচ এক দেশের বা এক সৎ ব্যক্তির চাঁদ দেখা অন্য সকল দেশের ও সকল মুসলিমের জন্য গ্রহণীয় কি না? একটি ইসলামের গৌণ ও ইজতেহাদী বিষয়।

তৃতীয়তঃ ধরুন আমরা বর্তমান পৃথিবীর মুসলিমরা এক সাথে রোযা শুরু করতে লাগলাম এবং এক দিনে ঈদ করতে লাগলাম। তাতে কি মুসলিম উম্মার মধ্যে শির্ক দূরীভুত হবে? বিদআতীরা বিদআত প্রত্যাখ্যান করবে? বিভিন্ন দলে বিভক্ত মুসলিম সমাজ তাদের দল ও মত প্রত্যাখ্যন করে এক হবে?  বিভিন্ন মুসলিম দেশ তাদের ভৌগলিক সীমা ছেড়ে এক সীমানায় একত্রিত হবে? বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে অবগত পাঠক অবশ্যই এর উত্তরে হাঁ বলতে পারেন না; কারণ এটা কল্পনা মাত্র বাস্তবতা নয়। মনে রাখা উচিৎ মুসলিম উম্মার এক দিনে রোযা শুরু করা ও এক দিনে ঈদ পালনের ঐক্য অপেক্ষামুসলিম উম্মার তাওহীদের প্রতি ঐক্য অধিকতর গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চতুর্থতঃ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ঐক্য ও সংহতির সম্পর্ক চন্দ্র দর্শনে ঐক্যের সাথে নেই। কারণ বিশ্বের মুসলিমগণ দৈনন্দিন নামাযের সময়ে এক নয়, রোযা শুরু ও ইফতার করার সময়ে এক নয়। আর এই পার্থক্য তাদের দলাদলিতে পরিণত করেনি। এই ভাবে মাসের শুরু ও শেষ হওয়াতে পার্থক্য হলেও তাদের দলাদলি হয় নি। এই কারণে বলা সঙ্গত যে, সকল মুসলিমের চন্দ্র দর্শনে ঐক্যবদ্ধ হওয়াতে, তাদের সকলের ঐক্য হওয়া আবশ্যিক নয়। বরং সত্যিকারে মুসলিম ঐক্য হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রাসূলকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে তার প্রতি আমল করা।

পঞ্চমতঃ এক মুসলিম ব্যক্তির হিলাল দর্শনকে সকল মুসলিমের দর্শন মনে করে যেই বিশৃংখল পদ্ধতিতে আমরা অনেকে ঐক্যের আহব্বান জানাচ্ছি, তা বর্তমানে মুসলিম উম্মতে যতখানি ঐক্য বিরাজ করছে, তাও ধ্বংসের পথে। তাই আজ দেখা যাচ্ছে, এক দেশে এক প্রদেশে এক অঞ্চলে এমনকি এক বাড়িতে তিন শ্রেণীর লোক। কেউ সংবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর সেই দেশের সাথে রোযা রাখছে, যেখানে তারা সবচেয়ে প্রথমে চাঁদ দেখেছে। কেউ সউদী আরবের সাথে আর কেউ নিজ দেশের দর্শন অনুযায়ী। এবার বলুন এটাই কি মুসলিম ঐক্য? এই ভাবে কি ঐক্য হয় ও হতে পারে? আসলে ঐক্য করতে গিয়ে যদি অনৈক্যই বেশী হয়, তাহলে তা অবশ্যই বর্জনীয়। তাই জনৈক সালাফ বলেছেনঃ জামাআত বদ্ধাকারে জীবন-যাপনের সময় তোমরা তাতে যা অপছন্দ কর, তা দলাদলিকারে জীবন-যাপনের সময় যা পছন্দ কর, তা থেকে উত্তম।

৫ম প্রমাণঃ জ্যোতির্বিদ্যায় এটা প্রমাণিত যে,  বিশ্বের মুসলিম দেশ সমূহ তা এক দেশ থেকে অন্য দেশটি যত দূরেই অবস্থান করুক না কেন চন্দ্র উদয় সময়ের মধ্যে সে সব দেশের সর্ব্বচ্চ ব্যবধান ৯য় ঘন্টার মত। আর এমন হলে সকল মুসলিম দেশ রাতের কোনো না কোনো অংশে চন্দ্র উদয় সময়ে একত্রিত হয়। তাই কোনো এক দেশে চাঁদ দেখা গেলে সংবাদ মাধ্যমে বাকী দেশগুলো তাদের দর্শনের উপর নির্ভর করে সাউম পালন করতে পারে।আর এই ভাবে এক সাথে সাউম পালন ও ঈদ করা সম্ভব।

আপত্তিঃ যে সবশারঈ বিধানের সম্পর্ক চন্দ্র দর্শনের সাথে রয়েছে, যেমন সাউম শুরু করা, ঈদ করা, তাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রহণীয় নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল এসব ক্ষেত্রে চন্দ্র দর্শনের আদেশ করেছেন নচেৎ মাসকে ৩০ দিন পূরণ করতে বলেছেন।

নবী (সাঃ) বলেনঃ “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু কর এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে ৩০ পূরণ কর”। [বুখারী মুসলিম] এই অর্থের আরোও প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা হাদীসের গ্রন্থসমূহে সিয়াম অধ্যায়ে দেখা যেতে পারে।

প্রমাণিত হল যে, নবী (সাঃ) রোযা করা কিংবা ঈদ করার আদেশ হিলাল দর্শনের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন কোনো অন্য নিয়ম বা হিসাবের সাথে নয়।

নবী (সাঃ) আরও বলেনঃ “আমরা উম্মী (নিরক্ষর) উম্মত, লিখতে জানি না, গণনা জানি না। মাস এমন, এমন, এবং এমন হয়। [তৃতীয় বার এমন বলার সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি মুড়ে রাখেন] তার পর বললেনঃ এবং মাস এমন, এমন, ও এমন অর্থাৎ পূর্ণ ৩০। [মুসলিম]

এখানে নবী (সাঃ) ‘এমন’ বলার সময় ২ই হাতের ১০ আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারা করলেন। তাই তিন ‘এমন’ অর্থাৎ তিন দশে ত্রিশ। কিন্তু তিনি (সাঃ) প্রথম তিন ‘এমন’ বলার সময় তৃতীয় বারে বুড়ো আঙ্গুল প্রশস্ত না করে মুড়ে রাখলেন মানে ২৯। অর্থাৎ মাস উনত্রিশা হয় এবং ত্রিশা হয়।

হাদীসে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নবী (সাঃ) এক দিকে বলছেন (লিখতে জানি না, গণনা জানি না) অথচ তিনি (সাঃ) আবার গণনা করছেন। অর্থাৎ সাধারণ গণনা তো আমরা জানি এই ভাবে এই ভাবে কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা বা চন্দ্র বিদ্যার সুক্ষ্ম হিসাব আমরা জানি না। অর্থাৎ নবী (সাঃ) এখানে সাধারণ নিয়ম ও গণনার কথা উল্লেখ করে তা গ্রহণ করার ও মানার নির্দেশ দেন, যা দ্বারা বুঝা যায় কোনো বিজ্ঞানের জ্ঞান যদিও তা সুক্ষ্ম হয়, তা এখানে প্রযোজ্য নয়।

উল্লেখ্য যে, চন্দ্র ও সৌর বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের উপর নির্ভর করে রোযা করা বা ছাড়া হলে দুটি বড় শারঈ বিধান উল্লংঘন হয়।

ক-সাউম ও ইফতারীর যেই শারঈ কারণ ইসলাম নির্ধারণ করেছে, অর্থাৎ চোখ দ্বারা হিলাল দর্শন, তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

খ-রোযা ও ইফতারের কারণ হিসাবে এমন নতুন কারণ মানা হয়, যার ইসলাম বিধান দেন নি। আর তা হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা সৌরবিজ্ঞান।

বিষয়বস্তুর সারাংশঃ

১-সারা বিশ্বে হিলাল উদয়স্থলে পার্থক্য থাকার কারণে বিভিন্ন দেশ ও প্রান্তে সেখানকার দর্শন অনুযায়ী সাউম পালন ও ঈদ উদযাপন স্বীকৃত হবে। এই নিয়ম যেমন দলীল সম্মত তেমন বিগত মুসলিম খুলাফাগণেরও পদ্ধতি। এমন কি যুগে যুগে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা মুসলিম সমাজের নিয়ম। ইতিপূর্বে তাঁরা কোনো মুসলিম দেশে চাঁদ দেখা দিলে সেই দর্শনের ফলে পৃথিবীর সকল মুসলিমকে জরূরী ভিত্তিক আর না মুস্তাহাব ভিত্তিক এক সাথে রোযা শুরু করার বা ঈদ করার ফরমান দিতেন।

ইমাম সুবক্বী তাঁর “আল্ ইলম আল্ মানশূর ফী ইসবাতিশ্ শহূর” গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ [... কারণ উমার বিন খাত্তাব এবং সমস্ত খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে এটা বর্ণিত নেই যে, তারা যখন হিলাল দেখতেন, তখন দূরবর্তী প্রদেশে পত্র লিখতেন। যদি উপরোক্ত বিধান তাদের উপর জরূরী হত, তাহলে তাঁরা তাদের অবশ্যই লিখতেন; কারণ তাঁরা দ্বীনের বিষয়ে যত্নশীল ছিলেন ......]

সউদী স্থায়ী উলামা কমিটি বলেনঃ “এই দ্বীন প্রকাশের পর ১৪ শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেছে, তাতে আমরা এমন কোনো এক সময়ের সম্পর্কে জানি না, যে সময়ে মুসলিম উম্মাহকে এক চন্দ্র দর্শনে একত্রীকরণ করা হয়েছিল। তাই শীর্ষস্থানীয় উলামা পরিষদ মনে করে, বিষয়টি যেন পূর্বের নিয়মে বলবৎ থাকে এবং তা যেন প্ররোচিত না করা হয়। [১০/১৩৫, মাক্তাবা শামেলা অনুযায়ী] তবে তারা একথাও বলেছেন যে, প্রত্যেক দেশ যেন উভয় মতের কোনো একটির প্রতি আমল করা বা না করার বিষয়ে তাদের দেশের উলামাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন।

২-বিষয়টি ইসলামের একটি ইজতিহাদী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তাতে মতভেদের অবকাশ তো রয়েছে কিন্তু তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া, বাড়াবাড়ি করতঃ দলাদলি করা, ইজতেহাদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ইজতিহাদ করা এবং ইজতেহাদে সালাফদের পদাংক অনুসরণ না করাচরম আপত্তিকর।

৩-যদি পৃথিবীর কোনো এক দেশে হিলাল দেখা দেয়, তাহলে তাদের দর্শনের ভিত্তিতে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম দেশবাসীর প্রতি সাউম শুরু করা ও ঈদ করা জরূরী হবে,কোনো দেশীয় কিংবা ভৌগলিক পার্থক্য করা যাবে না।

ক-এই মর্মে বর্ণিত দলীলগুলি আম তথা ব্যাপক হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একই সময়ে বাস্তবায়ন অসম্ভব; কারণ সারা পৃথিবীতে হিলালের উদয় সময় এক নয়।

খ-দলীলগুলি ব্যাপক হলেও একা একা আমলযোগ্য নয়; কারণ সাউম শুরু করা ও ঈদ করা একটি (ইজতেমাঈ) সম্মিলিতাকারে করার ইবাদত বিক্ষিপ্তাকারে করার নয়। নবী (সাঃ) বলেনঃ “সাউম সেদিন যেদিন তোমরা সকলে রোযা রাখ, আর ঈদ সেদিন, যেদিন তোমরা সকলে ঈদ কর, আর কুরবানী সেদিন যেদিন তোমরা সকলে কুরবানী কর”। [তিরমিযী, আবু দাঊদ, বায়হাক্বী, সহীহ সুনান তিরমিযী ১/২১৩]

গ-সরাসরি আমলে রয়েছে কিছু বাধা-বিঘ্ন যেমনঃ

          সকলের জন্য কোন্ দেশের হিলাল দর্শন গ্রহণীয় মনে করা হবে?

         কোনো একটি দেশের দর্শন স্বীকৃত হলে (চাঁদ দেখে রোযা কর এবং তা দেখে রোযা ছাড়)। এই হাদীসের প্রতি বিশ্বের বহু দেশের মুসলিম আর আমল করতে পারবে না। হিলাল দেখা এবং তা দেখে নবী (সাঃ) যেই দুআ পড়তে বলেছেন, তা আমল করাও আর তাদের ভাগ্যে জুটবে না; কারণ অনেক দেশের লোককে আর চাঁদ দেখার প্রয়োজন হবে না। স্বীকৃত দেশটি দেখবে আর বাকীগুলো কেবল তাদের সংবাদের ভিত্তিতে রোযা রাখবে এবং ঈদ করবে।

         যারা সন্ধায় পরিষ্কার আকাশে হিলাল দেখার চেষ্টা করেঅতঃপর যদি তা দেখতে না পায়, তাহলে সেই সকল মুসলিম বিনা সংকোচে নিদ্রা যেতে স্বাধীন কিন্তু যদি পৃথিবীর কোনো এক বিশেষ দেশের দর্শন স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে স্বভাবতঃ পৃথিবীর বহু দেশের সময়ের সাথে সেই দেশের সময়ের পার্থক্য হবে। এমতাবস্থায় কিছু দেশের লোকের প্রতি এই দায়িত্ব অর্পিত হবে যে, তারা যেন রাত জেগে সেই দেশের সংবাদের অপেক্ষা করে। অতঃপর হাঁ বা না’র সংবাদ রাতেই দেশবাসীদের পৌঁছে দেয়। আর এটি একটি এমন দায়িত্ব ও কর্তব্য যা ইসলাম আমাদের দেই নি।

         শাবান মাসের ২৯ তারিখে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা না দিলে, তাদের জন্য ৩০ শাবান পূরণ করতে নবী (সাঃ) আদেশ করেছেনে। সেখানকার লোকদের জন্য ৩০ শাবান হচ্ছে (ইয়ামুশ্ শাক্ক) সন্দেহের দিন। এরা যদি সে দিন অন্য দেশের সংবাদের ভিত্তিতে রোযা রাখে তাহলে, তারা সন্দেহের দিনে রোযাপালনকারী হবে না কি? অথচ নবী (সাঃ) সন্দেহের দিনে সাউম পালন করতে নিষেধ করেছেন। বলতে পারেন এক পর্যায়ে পৃথিবীতে আর সন্দেহের দিনই থাকবে না।

এই রকম আরো প্রচুর বাধা-বিঘ্নের কারণে সরাসরি উক্ত মত পালন করা অনুচিত।

৪-যদি মুসলিম দেশের (ইমাম) শাষক তাঁর দেশের জনগণকে উপরোক্ত মত গ্রহণে আদেশ দেন, অর্থাৎ অন্য দেশের হিলাল দর্শন তাঁর দেশের জন্য প্রযোজ্য মনে করেন, তাহলে তা গ্রহণীয়। আর যদি দেশের ইমাম আদেশ না দেন কিংবা মুসলিম শাষকের অবর্তমানে মুসলিমগণ দ্বীনী বিষয়ে যে সব সংস্থা বা উলামাদের অনুকরণীয় মনে করেন, তারাও যদি উক্ত মতের পক্ষে আদেশ না দেন, তাহলে বিক্ষিপ্তাকারে একই দেশে বিভিন্ন স্থানে রোযা শুরু করা বা ঈদ করা অবৈধএবং মুসলিম জামাআতে ফাটল সৃষ্টিকারীর সমতুল্য।

৫-হিলাল দর্শনে ঐক্যের মাধ্যমে মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধকরণ একটি খোঁড়া যুক্তি যা, বাস্তবতা বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ঐক্য হচ্ছে তাওহীদের ঐক্য, কিতাবুল্লাহ ও সহীহ সুন্নাতে রাসূলিল্লাহর প্রতি আমলের ঐক্য। আর তা হিলাল ঐক্যে অর্জন হতে পারে না।

৬-উলামাদের নিকট মন্দদূরীকরণের নীতি হচ্ছে, প্রথমে তা যে শরীয়ার দৃষ্টিতে মন্দ তা প্রমাণিত হতে হওয়া। অতঃপর তা অপসারণে যদি তার থেকে বেশী মন্দ স্থান নেয়, তাহলে সেই মন্দ দূরীভূত করা জায়েয নয়।[মাজমুউল ফাতাওয়া-১৪/৪৭২/ ইলামুল মুআক্বিয়ীন, ইবনুল ক্বাইয়্যুম] তাই বিভিন্ন স্থানে হিলাল উদয়ের পার্থক্যের কারণে মুসলিমগণ যেই ভাবে হিলাল দেখে রোযা রাখে বা ছাড়ে, স্বয়ং এই নিয়মটি কোনো মন্দ নিয়ম নয়। তাই তা অপসারণের চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই।অতঃপর এই নিয়ম অপসারণের চেষ্টা করা হলে যদি দেখেন যে, দেশ, সমাজ, এমনকি স্বয়ং এক পরিবারে অনৈক্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং বৃহৎ মুসলিম দল ভেঙ্গে আরো ছোট ছোট উপদলে পরিণত হচ্ছে, তখন এমন ঐক্যের ডাক মূলতঃ অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির ডাক, যা বর্জনীয়।

[ওয়াল্লাহু আ’লাম]


লেখক: শাইখ আব্দুর রাকিব আল-বুখারী

লিসান্স, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, খাফজী দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
Email: a.raquib1977@yahoo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ