ঈদে মীলাদুন নবী (সা.) কেন বিদ'আত?
বর্তমানে মুসলিমদের
বিরাট একটি অংশ ঈদে মীলাদুন্ নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের জন্ম দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখে বিশেষ
অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এমন কি যারা ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়গুলো পালন
করতে আগ্রহী নয় তারাও এটি পালনে বেশ তৎপর। আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা,
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও এক শ্রেণীর পীর-মাশায়েখ এবং আলেম-উলামার বক্তব্যেও
এর বিশেষ গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়। বেশ কিছু মুসলিম দেশে এ উপলক্ষে সরকারী
ছুটি ঘোষণা করা হয়। আজ আমি এই প্রবন্ধে রবিউল ও ঈদে মীলাদুন নবী উপলক্ষে
একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উপস্থাপন করছি। আশা করি এটি পাঠ করে অনেকেরই ভুল
ভাঙবে।
ঈদে মীলাদুন্নবী মূলত: অমুসলিমদের অনুকরণ
মূলত: অমুসলিম
ইয়াহুদ-নাসারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম)এর জন্ম দিবস উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ
মুসলিমরা এবং একদল গোমরাহ আলেম প্রতি বছর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম)এর জন্ম উপলক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ
কেউ মসজিদে এ অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার কেউ ঘর বা বিশেষভাবে এর জন্য
প্রস্তুতকৃত স্থানে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। আর এতে শত শত সাধারণ লোক
উপস্থিত হয়। তারা নাছারাদের অন্ধ অনুসরণ করেই এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে
থাকে।
এ অনুষ্ঠানে বিদআত ও
নাসারাদের সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিরক ও
অপছন্দনীয় কর্ম-কাণ্ড। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রাসূল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা
আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু’আ করা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা পর্যন্ত নিয়ে
যায়। অথচ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রশংসার
ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন:
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
“নাসারাগণ যেমন
মরিয়ম পুত্র ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, তোমরা আমার ব্যাপারে
সেরূপ বাড়াবাড়ি করোনা। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে
আল্লাহর বান্দা ও রাসূল বল।”
নাসারারা ঈসা
(আঃ)এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে আল্লাহর পুত্র হওয়ার আসনে বসিয়েছিল। আবার
কেউ কেউ তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ হিসাব বিশ্বাস করে তাঁর ইবাদত শুরু করেছে।
কেউ বা তাঁকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছ
বিদআতী নবী প্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন।
ঈদে মীলান্নবীতে নানা ধরণের বিদআত ও পাপাচার
তাছাড়া এসমস্ত
মীলাদ মাহফিলে যে সমস্ত পাপ কাজের চর্চা করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে
দলবদ্ধভাবে গান-বাজনা করা, ঢোল বাজানো এবং সূফীদের বানানো বিদআতী নিয়মে
বিভিন্ন জিকির-আজকার করা। কখনও কখনও নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এসমস্ত কাজে
অংশ নিয়ে থাকে। যার কারণে অনেক সময় অশালীন কাজকর্ম সংঘটিত হওয়ার সংবাদও
শুনা যায়। এমন কি যদি এ সমস্ত অনুষ্ঠান এধরণের অশ্লীল কাজ হতে মুক্ত হয়
এবং শুধুমাত্র একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির মাঝে সীমিত
থাকে, তথাপিও তা বৈধ নয়। কারণ তা নব আবিষ্কৃত বিদআত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন “দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত।
আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী”। তাছাড়া এতে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মত অশ্লীল
কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
মীলাদ কেন বিদআত?
আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত বলি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনারা বিদআত বলেন? উত্তর হল, আল্লাহর
কিতাব, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত, সাহাবাদের
আমল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোন যুগে এর কোন অস্তিত্ব ছিলনা। তাই আমরা
এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কমনা করা হবে,
কুরআন বা সুন্নায় অবশ্যই তার পক্ষে একটি দলীল থাকতে হবে। আর মীলাদ
মাহফিলের পক্ষে এরকম কোন দলীল নেই বলেই এটি একটি বিদআতী ইবাদত, যা হিজরী
চতুর্থ শতাব্দীর পর তৈরি করা হয়েছে। মিশরের ফাতেমীয় শিয়া সম্প্রদায়ের শাসকগণ এটাকে সর্বপ্রথম ইসলামের নামে মুসলমানদের মাঝে চালু করে।
বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হাফস্ তাজুদ্দীন ফাকেহানী (রঃ) বলেন, একদল লোক আমাদের কাছে বার বার প্রশ্ন করেছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষ মীলাদ নামে রবিউল আওয়াল মাসে যে অনুষ্ঠান করে থাকে, শরীয়তে কি তার কোন ভিত্তি আছে? প্রশ্নকারীগণ সুস্পষ্ট উত্তর চেয়েছিল।
আমি আল্লাহর উপর
ভরসা করে উত্তর দিলাম যে, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এর পক্ষে কোন
দলীল পাই নি এবং যে সমস্ত আলেমগণ মুসলিম জাতির জন্য দ্বীনের ব্যাপারে আদর্শ
স্বরূপ, তাদের কারও পক্ষ থেকে এধরণেরে আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অথচ
তারা ছিলেন পূর্ববতী যুগের (সাহাবীদের) সুন্নাতের ধারক ও বাহক। বরং এই
মীলাদ নামের ইবাদতটি একটি জঘণ্য বিদআত, যা দুর্বল ঈমানদার ও পেট পূজারী
লোকদের আবিষ্কার মাত্র।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন, এমনি আরও বিদআতের উদাহরণ হল, কিছু সংখ্যক মানুষ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম দিবসকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত: এ উপলক্ষে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। অথচ রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঠিক জন্ম তারিখ সম্পর্কে আলেমগণ যথেষ্ট মতবিরোধ করেছেন। এ ধরণের অনুষ্ঠান পালনকারীদের দু’টি অবস্থার একটি হতে পারে। হয়ত তারা এব্যাপারে ঈসা (আঃ) এর জন্ম দিবস পালনের ক্ষেত্রে নাসারাদের অনুসরণ করে থাকে অথবা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি অতি ভালবাসা ও সম্মান দেখানোর জন্য করে থাকে।
যাই হোক এ কাজটি
সাহাবাদের কেউ করেন নি। যদি কাজটি ভাল হত, তাহলে অবশ্যই তারা কাজটি করার
দিকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী থাকতেন। তাঁরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম)কে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন এবং সম্মান করতেন।
তাঁরা ছিলেন ভাল কাজে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী। তবে তাদের ভালবাসা ও
সম্মান ছিল তাঁর অনুসরণ, আনুগত্য, তাঁর আদেশের বাস্তবায়ন এবং প্রকাশ্যে ও
অপ্রকাশ্যে তাঁর সুন্নাতকে বাস্তবায়িত করার ভিতরে। তিনি যে দ্বীন নিয়ে
প্রেরিত হয়েছিলেন, তার প্রচার ও প্রসারের ভিতরে এবং অন্তর-মন, জবান এবং
শক্তি দিয়ে সে পথে জিহাদের মাধ্যমে। এটিই ছিল উম্মতের প্রথম যুগের আনসার ও
মুহাজেরীনে কেরাম এবং উত্তম ভাবে তাদের অনুসারী তাবেয়ীগণের পথ।
মীলাদ নামের এ
বিদআতটির প্রতিবাদে ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করা হয়েছে। এতে বিদআত ও
নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে অন্যান্য মীলাদ অনুষ্ঠানের দ্বার
উন্মুক্ত করার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন মাশায়েখ ও নেতাদের মীলাদ পালন করা,
যাতে মন্দ কাজের আরও অনেক দরজা খোলার ভয় রয়েছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে।
বর্তমানে এ মীলাদ মাহফিল শুধুমাত্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম)এর জন্ম দিবসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নেতা-নেত্রী, পীর-ফকীর,
শায়েখ-মাশায়েখ এমনকি সাধারণ মানুষের জন্ম দিবসেও মীলাদ মাহফিল উদযাপন করা
হয়ে থাকে।
কারো জন্মোৎসব পালন করা জায়েয কি?
শাইখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রঃ) বলেন,
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা অন্য কারও জন্মোৎসব পালন করা
জায়েজ নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দ্বীনের মাঝে একটি
নতুন প্রবর্তিত বিদআত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনও একাজ
করেন নি। তাঁর নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন নবী বা তাঁর কোন আত্মীয়,
কন্যা, স্ত্রী অথবা কোন সাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেন নি। খোলাফায়ে
রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেয়ীদের কেউ একাজ করেন নি। এমন কি পূর্ব
যুগের কোন আলেমও এমন কাজ করেন নি। তাঁরা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে
অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তার
শরীয়ত পালনকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। যদি এ কাজটি ছওয়াবের হত, তাহলে আমাদের
আগেই তাঁরা এটি পালন করতেন।
বিদআত বর্জনের ব্যাপারে দলীল সমূহ:
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ
দ্বীন। এ দ্বীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া
হয়েছে এবং বিদআত থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
« مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ »
“আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” সহীহুল বুখারী
তিনি আরও বলেন:
وَإِيَّاكُمْ
وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّهَا ضَلاَلَةٌ فَمَنْ أَدْرَكَ ذَلِكَ
مِنْكُمْ فَعَلَيْهِ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ
الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ »
“তোমরা আমার
সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা
দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার
করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং
প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা”। (তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: সুন্নত গ্রহণ, ইমাম
তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ)
এসমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়া’লা বলেন:
فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“অতএব, যারা তাঁর
নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ
বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিতনা (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা
যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে।” (সূরা নূর: ৬৩)
আল্লাহ তায়া’লা আরও বলেন:
وَمَاَآتاَكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا
“তোমাদের জন্য
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তা
গ্রহণ কর। এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক।
(সূরা হাশর: ৭)
আল্লাহ আরও বলেন :
وَلَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ
তোমাদের মধ্যে যারা
আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি
কামনা করে, তাদের জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর জীবনীতে
এক সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাবঃ ২১)
আল্লাহ বলেন:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজকের দিনে
তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার
নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত
করলাম।” (সূরা মায়েদাঃ ৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে
সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য মনোনীত দ্বীনকে
আল্লাহ তায়া’লা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ওফাতের পূর্বেই
পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, তাঁর
ওফাতের পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যে সব নতুন প্রথার উদ্ভাবন করে শরীয়তের
সাথে যুক্ত করবে, তা বিদআত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এগুলোর উদ্দেশ্য
ভাল হয়। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে জনগণকে সতর্ক করেছেন ও
ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মের ভিতরে অতিরিক্ত সংযোজন, যার অনুমতি
আল্লাহ তায়া’লা কোন মানুষকে প্রদান করেন নি। ইহা আল্লাহর দুশমন
ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সাথে
সামঞ্জস্য স্বরূপ। সুতরাং এরূপ করার অর্থ এই যে, ইসলাম অসম্পূর্ণ ছিল।
মীলাদপন্থীরা মীলাদের মাধ্যমে তা পূর্ণ করে দিলেন। এটা যে কত বড় অপরাধ এবং
আল্লাহর বাণীর বিরোধী, তা সর্বজন বিদিত। আল্লাহ বলেন:
اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” (সূরা মায়েদাঃ ৩)
মীলাদ মাহফিল বা
নবীর জন্মোৎসব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের দ্বারা এ
কথাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়া’লা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান
করেন নি এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উপর অর্পিত
রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন নি। পরবর্তীতে মীলাদপন্থীরা এসে তাকে পূর্ণ
করে দিয়েছেন। এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং এধরণের ইবাদত তৈরি করার
মাধ্যমে আল্লাহ তায়া’লা এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম)এর উপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য
ধর্মকে সার্বিকভাবে পূর্ণ করত: তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রাসূল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের সুস্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে
পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন কোন পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এবং
জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বলে দিতে কোন ত্র“টি করেন নি।
এ কথা সকলের জানা
যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে
অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ
মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীনের অংশ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই উম্মতের
কাছে বর্ণনা করতেন বা তাঁর সাহাবীগণ তা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া
যায়না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মীলাদ মাহফিলের কোন সম্পর্ক
নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর
উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন।
যদি আমরা এই মীলাদ
মাহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মাজিদের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই
আল্লাহ তায়া’লা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে যা আদেশ
করেছেন বা যা থেকে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাদেরকে তা অনুসরণ করার আদেশ
দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি এই দ্বীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণতা
দান করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তার
মধ্যে মীলাদ মাহফিলের কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। এভাবে যদি আমরা সুন্নাতের
দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) একাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমন কি তাঁর সাহাবীগণও তা করেন
নি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং
ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের উৎসব সমূহের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। যে ব্যক্তির
সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা বুঝার সামান্য আগ্রহ রাখে, তার
বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মাহফিল বা যাবতীয় জন্ম
বার্ষিকী পালনের কোন সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদআতসমূহ থেকে রাসূলুল্লাহ
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছেন, এটি সেগুলোরই
অন্তর্ভুক্ত।
বিভিন্ন স্থানে
অধিক সংখ্যক লোক এই বিদআতী কাজে লিপ্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে
প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সঠিক পথ জানা
যায়না। বরং শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়।
এই মীলাদ মাহফিল
সমূহ বিদআত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় অন্যান্য পাপের কাজ থেকেও মুক্ত
নয়। যেমন নারী-পুরুষের মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার
ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শিরকে আকবার তথা বড় ধরণের শিরকও সংঘটিত
হয়ে থাকে। আর তা হল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও অন্যান্য
আওলীয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু’আ করা, সাহায্য
ও বিপদ মুক্তির প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তারা গায়েবের
খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।
অতীব আশ্চর্যের
বিষয় এই যে, অনেক লোক এ ধরণের বিদআতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে
খুবই তৎপর ও সচেষ্ট এবং এর পিছনে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে প্রস্তুত।
এধরণের অনুষ্ঠানের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে তারা দ্বিধা বোধ করে
না। অথচ তারা নামাযের জামাতে ও জুমআতে অনুপস্থিত থাকাতে বিন্দুমাত্র
কুণ্ঠাবোধ করে না। যদিও আল্লাহ তা’আলা এ আমলগুলো পালন করা ওয়াজিব করেছেন।
তারা এটাও উপলব্ধি করে না যে, নামাযের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ছেড়ে দিয়ে
তারা চরম অন্যায় করছে। নিঃসন্দেহে এটা দুর্বল ঈমানের পরিচয় এবং পাপাচারের
মাধ্যমে অন্তরকে কুলষিত করে নেয়ার পরিচয় বহন করে।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীলাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ধরণা বিরাট মূর্খতা ছাড়া অন্য কিছু নয়
আরও বিস্ময়কর
ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাড়িয়ে যায়।
এটা বিরাট মূর্খতা ও অসত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা
কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোন সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না।
বরং কিয়ামত পর্যন্ত অন্যান্য নবীদের মতই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন এবং
তাঁর পবিত্র রূহ মোবারক প্রভুর নিকট ঊর্ধ্বাকাশে ইল্লিয়ীনের সম্মানজনক
স্থানে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তাআ’লা বলেন;
ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ
“এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে।” (সূরা মুমেনুনঃ ১৬)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
أنا أول من ينشق عنه القبر وأول شافع وأول مشفع
‘কিয়ামতের দিন
আমার কবরই সর্বপ্রথম উম্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার
সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।” (সহীহ মুসলিমঃ হাদীছ নং- ২২৭৮)।
রাসূল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর দরূদ পাঠ করা ও সালাম পাঠ করা
নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা। যেমন
আল্লাহ তায়া’আলা বলেছেন:
اِنَّ اللّهَ وَ
مَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ
اَمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا
“নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠান। হে মুমেনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠাও।” (সূরা আহযাবঃ ৫৬)
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا
“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠায়, আল্লাহ তার প্রতিদান স্বরূপ তাঁর উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।” (সহীহ মুসলিম)
সব সময়ই নবী
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর দরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে
নামাযের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে বরং নামাযের মধ্যে শেষ
তাশাহ্হুদে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দরূদ পড়া সুন্নাতে
মুআক্কাদা। যেমন আযানের পরে, জুমআর দিনে ও রাতে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নাম উল্লেখ হলে। এব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে।
এরূপ বিদআতী
অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে, যারা তাদের আক্বীদা ও রাসূল
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ভালবাসার ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা
রাখে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নি ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম)এর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তাঁর কোন
সাহাবী বা তাঁদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি একাজটি করেছেন? না এটা
ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ?
এধরণের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম)এর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয়না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়,
তা হল তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করা, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা
থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল
সেভাবেই তাঁর উপাসনা করা।
কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা
এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে
মুসলমানদের জন্য ইহ ও পর কালীন কল্যাণ ও মুক্তি।
লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, এম,এম, ফাস্ট ক্লাশ
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, এম,এম, ফাস্ট ক্লাশ
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী আব্দুল জলীল
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
0 মন্তব্যসমূহ